ত্রালুস একটু এগিয়ে এসে বলল, কীশা কি মারা গেছে? রোবট কি মারা যায়?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কীশা আসলে পুরোপুরি রোবট ছিল না। একটা সত্যিকার মানুষের মাথায় তার মস্তিষ্কের একটা অংশে কপোট্রন লাগিয়ে ওকে তৈরি করা হয়েছে। কপোট্রনটা শরীরের উপর নির্ভর করে ছিল। শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে কপোট্রনটা আর থাকতে পারে না। আমার ধারণা ওর কপোট্রনটাও আর কাজ করছে না।
ইরন কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে শুনতে পেল খুব চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে কেউ তাকে ডাকছে। ইরন চমকে উঠল, কে?
আমি। আমি কীশা।
ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ল, কীশা তুমি বেঁচে আছ?
আমি জানি না। এটা বেঁচে থাকা কি না। যদি এটা বেঁচে থাকাও হয় তা হলেও আমি আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকব না। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে বলে খুব দ্রুত আমার সবকিছু একটি একটি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন আর কিছু দেখতে পারছি না।
কীশা, আমরা খুব দুঃখিত। আমরা
আমি জানি। আমাকে তারা রোবট হিসেবে তৈরি করেছিল কিন্তু আমার ভিতরে যেটুকু স্মৃতি, যেসব অনুভূতি সব আমার নিজের। আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ নিশ্চয়ই এখনো কোথাও রয়ে গেছে। মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা কী আমি জানি ইরন।
আমরা কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি, কীশা?
না। কিছু করতে পারবে না। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, কষ্ট করে বলে, আমি ভোকাল কর্ডকে আর ব্যবহার করতে পারছি না, আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ইরন
বল কীশা।
আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের ভয়াবহ বিপদে এনে ফেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি নিজের ইচ্ছায় করি নি। আমার কোনো উপায় ছিল না।
আমরা জানি।
তোমাদের কথাও এখন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ভালো করে আর শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে আমি ভেসে ভেসে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু বুঝতে পারছি না।
কীশা। কীশা। ইরন চিৎকার করে ডাকল, কীশা।
বল ইরন।
ইরন চিৎকার করে উঠল, আমরা তোমাকে ভুলব না। আমরা সবসময় তোমাকে মনে রাখব। তোমার জন্য সবসময় আমাদের বুকে ভালবাসা থাকবে কীশা।
ভালবাসা। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, মানুষের ভালবাসা। আহা! কেন ওরা আমাকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দিল না? কেন?
ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করে বলল, কীশা শরীরের গঠন দিয়ে মানুষ হয় না, নিউরন৩৪ আর সিনাপ্সের সংযোগ দিয়ে মানুষ হয় না, কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়েও মানুষ হয় না। মানুষ হচ্ছে তার বুকের ভিতরের অনুভূতি। তুমি মানুষ কীশা, তুমি মানুষ, তুমি পুরোপুরি একজন মানুষ।
আমি শুনতে পাচ্ছি না ইরন। মনে হচ্ছে আমি বহুদূরে চলে যাচ্ছি, বহুদূরে। বহুদূরে–
ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি মানুষ কীশা। তুমি আমাদের মতো মানুষ। তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা। ভালবাসা।
কীশা ফিসফিস করে বলল, ভালবাসা? আমার জন্য ভালবাসা? তার গলার স্বর একেবারে অস্পষ্ট হয়ে আসে, অনেক চেষ্টা করেও আর তার কথা শোনা গেল না।
ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বলল, কীশার কপোট্রন থেমে গেছে।
৩.৪ শুমান্তি আর ত্রালুস
শুমান্তি আর ত্রালুস কোনো কথা বলল না, শূন্য দৃষ্টিতে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন ঘুরে ত্রালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী এক্ষুনি নিশ্চয়ই আবার নিশিকে নিতে আসবে।
ত্ৰালুস জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব ইরন?
প্রথমে খুব সাবধানে নিশির শরীরের সাথে বাধা ঐ সিগন্যাল বিকনটি৩৬ ধ্বংস করে দাও। তারপর নিশিকে মুক্ত করে স্কাউটশিপে ফিরে চল।
শুমান্তি বলল, আমাদের নিজেদের স্কাউটশিপে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কীশার স্কাউটশিপটাই ব্যবহার করতে পারব।
হঁ। ঠিকই বলেছ। ইরন চিন্তিত মুখে বলল, শেষ পর্যন্ত কী হবে আমরা জানি না। চতুর্মাত্রিক প্রাণীর সাথে ত্রিমাত্রিক প্রাণী যুদ্ধ করতে পারে না। আমরা বেশিরভাগ সময় তাদের দেখতে পর্যন্ত পাই না।
কিন্তু তুমি বলেছ, তারাও পায় না। অসীমসংখ্যক ত্রিমাত্রিক জগৎ আছে তার কোনটার মাঝে আমরা আছি তারা জানে না।
কিন্তু এখন জানে–নিশির শরীরের সাথে সিগন্যাল বিকন বেঁধে রেখেছে, সেখান থেকে সঙ্কেত বের হচ্ছে। তারা সেই সঙ্কেত দিয়ে আমাদের খুঁজে বের করেছে।
ত্রালুস বলল, তা হলে প্রথমে এই বিকটাই উড়িয়ে দিই।
ত্রালুস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে নিশির দিকে এগিয়ে যায়। নিশিকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে সে বিকনটির দিকে অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে। একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, কালো ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল বিকনটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। নিশি তার শরীরের সাথে বাধা শেকলটি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে।
আমার নাম ত্রালুস।
ধন্যবাদ ত্রালুস।
শুমান্তি এগিয়ে এসে বলল, আমি শুমান্তি।
নিশি শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বাঁচানোর জন্য এসেছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
ইরন আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ দেওয়ার কিংবা নেওয়ার সময় মনে হয় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী আবার আসছে। আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাবার চেষ্টা করা উচিত।