ইরন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, সর্বনাশ! কী মন–খারাপ–করা একটা জায়গা। দেখে মনে হয় এখানে অভ কিছু একটা আছে।
ত্রালুস সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নিচে নামতে নামতে বলল, ঠিকই বলেছ।
এ রকম জায়গায় যে প্রাণীরা থাকে তারা বুদ্ধি কি না জানি না, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই খুব বিষণ্ণ প্রকৃতির। শুমান্তি তরল গলায় বললু এখানে আনন্দ পাবার কিছু নেই।
সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে ত্ৰালুস সাবধানে মাটিতে পা রেখে বলল, মাটি শক্ত নয়, অনেকটা ভেজা বালির মতো।
ইরন বলল, সাবধানে যাও ত্রালুস।
হা, ত্ৰালুস খুব সাবধান।
ভাসমান জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের ভারী বাক্স এবং যন্ত্রপাতি রেখে এক হাত দিয়ে সেটাকে টেনে ত্রাপুস সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে, অন্য হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি ধরে রাখে। ত্ৰালুসের পর শুমান্তি এবং সবার শেষে ইরন, দুজনেই অনভ্যস্ত হাতে একটি করে অস্ত্র ধরে রেখেছে।
সবুজাভ আবছা আলোতে তিন জন নিজেদের মাঝে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে থাকে। ঝড়ো হাওয়া কখনো সামনে থেকে কখনো পিছন থেকে আসছে। বাতাসে এক ধরনের সূক্ষ্ম বেগুনি রঙের ধুলো উড়ছে। স্পেসসটের চোখের সামনে ভিজরটি বারবার মুছেও পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না।
তিন জন বাতাসের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে শুনতে সামনে এগুতে থাকে। বড় বড় বিচিত্র পাথরের মাঝে জায়গা করে হাঁটতে হাঁটতে শুমান্তি জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন দিকে। যাচ্ছি?
ত্রালুস ভাসমান জেট প্যাকে একটা মনিটর দেখে বলল, কীশার স্কাউটশিপ থেকে একটা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে। সেটা লক্ষ্য করে যাচ্ছি।
কতদূর যেতে হবে?
খুব বেশি দূরে নয়। বড়জোর এক কিলোমিটার।
যদি সোজাসুজি যেতে পারি তা হলে এক কিলোমিটার। কিন্তু যেরকম পথ দিয়ে যাচ্ছি কোনো কি নিশ্চয়তা আছে?
নেই। সত্যি কথা বলতে কী, হঠাৎ যদি বেগুনি রঙের একটা বিষাক্ত হ্রদের সামনে এসে পড়ি তা হলে বিপদ হয়ে যাবে।
ইরন বলল, তখন এক জন এক জন করে এই জেটপ্যাকে করে হ্রদ পার হতে হবে।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।
সৌভাগ্যক্রমে পথে হঠাৎ করে টগবগে বেগুনি রঙের তরলের কোনো হ্রদ ছিল না, নানা আকারের পাথরের মাঝে পথ করে ভেজা বালুর মতো মাটির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তারা শেষ পর্যন্ত কীশার স্কাউটশিপের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। কয়েক শত মিটার উঁচু কয়েকটা পাথরের পিছনে, ধূসর আকাশের খোলা আলোতে স্কাউটশিপটিকে একটি অতিকায় পশুর মতো দেখায়। ত্ৰালুস দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল চোখে লাগিয়ে কীশা এবং নিশিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণ খুঁজেই তাদের পাওয়া গেল। স্কাউটশিপ থেকে দু শ মিটার দূরে কয়েকটা গোলাকার মসৃণ পাথরের সামনে অপেক্ষা করছে। নিশি হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে কীশা। নির্জন একটি গ্রহে ঝড়ো বাতাসের কুদ্ধ গর্জনের মাঝে দুজনকে এভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটিকে হঠাৎ করে একটি অপার্থিব অশরীরী দৃশ্য বলে মনে হয়।
ত্রালুস তার অস্ত্রটিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এখন আমরা কী করব?
ইরন বহুদূরের কীশা এবং নিশির অবস্থানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা কথা বলার জন্য গোপন চ্যানেল ব্যবহার করছি, তাই কীশা সম্ভবত আমাদের কথা শুনতে পায় নি, এখনো জানে না আমরা তার এত কাছে চলে এসেছি।
ত্রালুস বলল, কিন্তু অনুমান করতে পারছে।
হ্যাঁ, সম্ভবত পারছে। আমার মনে হয় আমরা এখন তিনটি ভিন্ন জায়গা থেকে কীশার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যাই।
ত্রালুস মাথা নাড়ল, বলল, সরাসরি তাকে বলতে হবে, এই মুহূর্তে নিশিকে চলে আসতে দিতে হবে। যদি না দেয় আমরা তাকে শেষ করে দেব। রোবটকে শেষ করায় কোনো অপরাধ নেই।
ইরন ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখ, আমি কীশাকে এখনো একটা রোবট বলে ভাবতে পারছি না।
কিন্তু
শুমান্তি ত্রালুসকে বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ব্রালুস। আমিও পারছি না। আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না, শুধু ব্যবহার করার ভয় দেখাব।
সেটা করতে হলে তোমাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে হবে যে তুমি অস্ত্র ব্যবহার করবে।
না–তার প্রয়োজন নেই
শুমান্তি এবং ত্রালুসের মাঝে একটা ছোট বিতর্ক শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ইরন হাত তুলে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন কী ঘটবে আমরা জানি না, কাজেই কী করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে আমরা সেটাও জানি না। তাই ঘুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তিন দিক থেকে কীশাকে ঘিরে ফেলা যাক। ট্রিগারে হাত দেবার আগে খুব সাবধান, কীশা আর নিশি কিন্তু খুব কাছাকাছি।
ঠিক আছে।
ইরন আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বলে কয়েকটা জরুরি বিষয় ঠিক করে নেয়। তারপর একজন আরেকজনের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তিন জন তিন দিকে যেতে শুরু করে। জেট প্যাকটা এবারে ইরনের কাছে, সে সাবধানে সেটাকে টেনে নিতে থাকে।
আবছা অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে কীশার যেটুকু কাছে যাবার ইচ্ছে ছিল ইরন ততটুকু কাছে যেতে পারল না। তার আগেই হঠাৎ করে কীশা সচকিত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কে? কে ওখানে?
ইরন জেট প্যাকের পিছনে নিজেকে আড়াল করে বলল, আমি। আমি ইরন।
কীশাকে হঠাৎ করে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল, মনে হল কিছু একটা নিয়ে সে ভারি দুশ্চিন্তায় ছিল, হঠাৎ করে সেই দুশ্চিন্তার বিষয়টি অপসারিত হয়ে গেছে। সে খানিকটা খুশি খুশি গলায় বলল, ও, তোমরা এসেছ?