ইরন মাথা নাড়ল, না, জানি না। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। সেই হতভাগা মানুষের জীবনে কী হয়েছিল কে জানে! কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি তার আমার মতো অবস্থা হয় নি। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, কথা বলার লোক নেই, একাকী উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি
মহিলাটি বাধা দিয়ে বলল, এটাই জীবন। এটাই মানুষের জীবন। কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা, কখনো সুখ, কখনো।
ইরন হঠাৎ তার বিছানায় সোজা হয়ে বসে তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, চুপ কর। চুপ কর তুমি।
মহিলাটি বিভ্রান্তের মতো বলল, চুপ করব?
হ্যাঁ। তুমি মানুষের জীবনের কী জান? কিছুই জান না। তার কষ্টের কথা যন্ত্রণার কথা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই! তুমি একটা তৃতীয় শ্রেণীর প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে জীবন সম্পর্কে বক্তৃতা শোনাতে এসো না।
মহিলাটি আহত মুখে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার জীবনের কষ্ট, হতাশা আর যন্ত্রণার কথা নিয়ে আমার সাথে কথা বলবে। আমি তো নিজে থেকে আসি নি। তুমি আমাকে ডেকে এনেছ।
ইরন উত্তেজিত গলায় বলল, হ্যাঁ। তোমাকে আমি ডেকে এনেছিলাম, এখন আমিই তোমাকে বিদায় করে দিচ্ছি। তুমি দূর হও এখান থেকে।
মহিলাটি তুমি ধরনের বিস্ময় নিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউবে স্পর্শ করলেই আমি চলে যাব ইরন। আমি নিজে থেকে যেতে পারি না।
বেশ, তা হলে আমি তোমাকে সেভাবেই বিদায় করছি। ইরন টিউবটি স্পর্শ করতে হাতটি এগিয়ে দিতেই মহিলাটি স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, দাঁড়াও, ইরন।
কী?
তুমি কি সত্যিই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
হ্যাঁ।
তুমি কোনোভাবে তোমার মত পাল্টাবে না?
না।
তা হলে
তা হলে কী?
তা হলে তুমি তোমার আত্মহত্যাকে আরো একটু অর্থবহ কর না কেন? সম্পূর্ণ অকারণে নিজেকে মেরে ফেলে কী লাভ? তুমি যদি–
আমি যদি–
তুমি যদি একটা খুব বিপজ্জনক প্রজেক্টে অংশ নাও, যেখানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী–সেটি কি একটা মহৎ কাজ হয় না?
ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
মনে কর প্রজেক্ট আপসিলনের কথা। এই প্রজেক্ট মানবসভ্যতার একটা নতুন দ্বার খুলে দেবে। অথচ এর মতো বিপজ্জনক প্রজেক্ট কখনো প্রস্তুত হয় নি। কারো বেঁচে আসার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য তিন। আত্মহত্যা না করে তুমি যদি এই প্রজেক্টে যোগ দাও।
ইরন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পানীয়ের বোতলটি মহিলার উদ্দেশে ছুঁড়ে মারল। হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবির ভিতর দিয়ে বোতলটি ছুটে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ল। ইরন চিৎকার করে বলল, বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। মানুষের প্রাণ নিয়ে তুমি ব্যবসা করতে এসেছ?
মহিলাটি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার চেহারায় এক ধরনের ভয়ের ছাপ পড়ল, সে আতঙ্কিত হয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমি যদি তোমাকে ধরতে পারতাম, গলা টিপে খুন করে ফেলতাম।
কিন্তু তুমি তো ধরতে পারবে না। আমি–আমি তো সত্যি নই। আমাকে তো ধরা ছোঁয়া যায় না।
জানি। তোমাকে ধরা–ছোঁয়া যায় না। কিন্তু তুমি মানুষ মারা প্রজেক্টের জন্য লোক ধরে নিতে এসেছ? বেছে বেছে খোঁজ করছ আমার মতো মানুষদের!
মহিলাটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন তার আগেই কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউব স্পর্শ করে মহিলাটিকে অদৃশ্য করে দিল। ঘরের ভিতর হঠাৎ করে তার অবিন্যস্ত মন খারাপ–করা শোয়ার ঘরটি ফিরে আসে। দেয়ালে পানীয়ের লাল ছোপ, মেঝেতে ভাঙা বোতলের কাঁচ ছড়ানো। ইরন সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে উঠল, কী আশ্চর্য, সে একটা কৌশলী প্রোগ্রামের সাথে রাগারাগি করছে। কেমন করে সে এরকম হাস্যকর ব্যবহার করতে পারল?
ইরন কোয়ার্টজের জানালার দিকে তাকাল, একটা বড় ভ্রু ড্রাইভার এনে ক্রোমিয়ামের স্ন্যাপারগুলো খুলে সে এখনই জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়তে পারে কিন্তু হঠাৎ করে তার কেমন জানি ক্লান্তি লাগতে থাকে। কিছু না করার ক্লান্তি। অবসাদের ক্লান্তি। সে শ্রান্ত পায়ে নিজেকে টেনে এনে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
বিছানায় মাথা স্পর্শ করার সাথে সাথেই কিছু বোঝার আগেই ইরন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।
১.২ খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে
খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে প্রথম যে কথাটি ইরনের মাথার মাঝে খেলা করে গেল সেটি হচ্ছে প্রজেক্ট আপসিলন। কাল রাতে একটি নিম্নস্তরের কম্পিউটার প্রোগ্রাম তাকে এই বিপজ্জনক প্রজেক্টে জুড়ে দেবার চেষ্টা করছিল। ইরন বিছানায় উঠে বসে এবং খানিকটা চেষ্টা করেও মাথা থেকে প্রজেক্টের নামটি সরাতে পারে না। কুৎসিত বিকৃত কিছু দেখলে মানুষ যেরকম বিতৃষ্ণা নিয়েও তার থেকে চোখ সরাতে পারে না এটাও অনেকটা সেরকম। ইরন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কমিউনিকেশান্স মডিউলটি নিজের কাছে টেনে এনে সেটি চালু করল। নীলাভ স্ক্রিনে মডিউলের পরিচিত চিহ্নটি ফুটে উঠতেই ইরন নিচু গলায় বলল, তথ্য অনুসন্ধান।
কমিউনিকেশান্স মডিউল তার যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত হয়ে নেয়। ইরন আবার নিচু গলায় বলল, প্রজেক্ট আপসিলন।