ইরন একটু থেমে বলল, বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ, খানিকটা বুঝতে পেরেছি। পুরোটুকু না বুঝলেও ধারণাটুকু পেয়েছি।
শুমান্তি স্পেসসটটার ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, চতুর্মাত্রিক প্রাণী যেহেতু আছে, তার অর্থ চতুর্মাত্রিক জগৎও নিশ্চয়ই আছে। আমরা মানুষেরা সেখানে যেতে পারি না।
না, পারি না। এর অস্তিত্বের কথা জানার পরই নিশ্চয়ই প্রজেক্ট আপসিলন দাঁড়া করানো হয়েছে। পৃথিবীর একজন মানুষকে পাঠানো হয়েছে চতুর্মাত্রিক প্রাণীর কাছে। উপহার হিসেবে। বিনিময়ে এই প্রাণী আমাদের কাছে চতুর্মাত্রিক জগতে যাওয়ার প্রযুক্তি দেবে।
তোমার তাই ধারণা?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা।
দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুট পরা যতটুকু কঠিন মনে হয়েছিল দেখা গেল সেটি তার থেকে অনেক বেশি কঠিন। ইরন, শুমান্তি এবং ত্ৰালুস একজন আরেকজনকে সাহায্য করার পরও স্পেসস্যুটগুলো পরতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে গেল। জীবনরক্ষাকারী মডিউলটি পরীক্ষা করে লুস বলল, এটি ছয় ঘণ্টার মডিউল।
যার অর্থ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের এই স্কাউটশিপে ফিরে আসতে হবে?
জীবন্ত অবস্থায় স্কাউটশিপে ফিরে আসার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই, কিন্তু ইরন সেটি কাউকে মনে করিয়ে দিল না, বলল, হ্যাঁ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের ফিরে আসতে হবে।
ত্ৰালুস ভন্ট খুলে ভয়ঙ্কর ধরনের কয়েকটি অস্ত্র বের করে ইরন এবং শুমান্তির দিকে এগিয়ে দেয়। শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, আমি অস্ত্র চালাতে জানি না।
এর মাঝে জানার কোনো ব্যাপার নেই। যে জিনিসটাকে আঘাত করতে চাও সেটার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরবে।
শুমান্তি তবুও অস্ত্রটি নিতে চাইল না, বলল, না, আমি এটা স্পর্শ করতে চাই না।
ইরন একটু হেসে বলল, না চাইলেও তোমাকে নিতে হবে। আমরা ঠিক জানি না আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। হয়তো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু হয়তো অস্ত্র দেখাতে হবে।
শুমান্তি নেহায়েত অনিচ্ছার সাথে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি হাতে তুলে নেয়। সেফটি সুইচটি টেনে নিয়ে সে অস্ত্রটি পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ত্ৰালুস ভল্ট থেকে চতুষ্কোণ একটা ভারী বাক্স টেনে বের করে এনে বলল, ইরন, তুমি যেহেতু বলছ অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানোর প্রয়োজন হতে পারে তা হলে কি এই এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা সাথে নিয়ে নেব?
এন্টি ম্যাটার? সেটা দিয়ে কী করবে?
এটা চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে আটকে রাখা আছে। গুলি করে বাক্সটা ভেঙে দিলে গ্রহের অর্ধেকটা উড়ে যাবে।
ইরন কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, তা হলে নিয়ে যাওয়া যাক। কিন্তু এত ভারী এটা টেনে নিতে পারবে?
টেনে নিতে হবে না, ছোট একটা জেট প্যাক আছে।
.
বালুস জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা রেখে জেট প্যাকের ইঞ্জিনটা চাল করে দিতেই সেটা মিটারখানেক উপরে উঠে আসতে শুরু করে। ত্ৰালুস স্কাউটশিপ থেকে আরো কিছু যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।
চমৎকার। ইরন এগিয়ে গিয়ে স্কাউটশিপের দরজার সামনে দাঁড়াল। লাল রঙের একটা লিভার টেনে দিতেই ঘড়ঘড় শব্দ করে চারপাশের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে তাদেরকে পুরো স্কাউটশিপ থেকে আলাদা করে ফেলল। দরজার কাছে একটা কমলা রঙের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে, তার নিচে একটা বড় চতুষ্কোণ সুইচ। সেটা চাপ দিয়ে দরজাটি খোলার আগে ইরন ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে ঘুরে তাকাল, একমুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা আমাদের কী হবে জানি না। যদি আমরা বেঁচে ফিরে না আসি, তা হলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
শুমান্তি নরম গলায় বলল, তোমার ক্ষমা চাওয়ার বা দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেখে নিশি মেয়েটি কত খুশি হবে চিন্তা করে দেখ। সেই আনন্দটুকুর জন্য। জীবন দেওয়াটা এমন কিছু খারাপ নয়।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমাদের ওপর আমার একটু হিংসাই হচ্ছে। জীবনকে এভাবে দেখতে পারাটা মনে হয় খারাপ নয়।
ত্রালুস হেসে বলল, তুলনা করার জন্য আমরা অন্য কোনো জীবন পাই নি তাই বলতে পারছি না কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।
চল তা হলে, রওনা দেওয়া যাক।
ইরন চতুষ্কোণ সুইচটা চেপে ধরতেই প্রথমে স্কাউটশিপের বাতাস বের হয়ে বাইরের সাথে বাতাসের চাপ সমান হয়ে গেল। তারপর গোলাকার একটা দরজা ধীরে ধীরে উপরে। উঠে গেল। বাইরে সবুজাভ এক ধরনের আবছা আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। এক ধরনের ঝড়ো বাতাস বইছে এবং বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে শিশুর কান্নার মতো তীক্ষ্ণ এক ধরনের ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। স্কাউটশিপটি যেখানে নেমেছে সেই জায়গাটি মোটামুটি সমতল, কিন্তু সামনে যতদূর দেখা যায় উঁচুনিচু বিচিত্র আকারের পাথর। দেখে মনে হয় কেউ অনেক কষ্ট করে পাথরগুলো খোদাই করে এ রকম বিচিত্র রূপ দিয়েছে। বাইরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের অনেক অংশ তরল পদার্থে ঢাকা, বেগুনি রঙের তরল কোথাও টগবগ করে ফুটছে, কোথাও বিষাক্ত বাষ্প বের হয়ে ধোঁয়ার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। বড় পাথরগুলো এবং সমতল স্থানগুলোর স্থানে স্থানে বড় বড় ফাটল এবং সেই ফাটল দিয়ে সবুজাভ এক ধরনের আলো বের হয়ে পুরো এলাকাটি এক ধরনের অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।