যোগাযোগ মডিউলে মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে পাঠানো তথ্যগুলো তিন জন মিলে দেখতে থাকে। প্রাণীটার শরীরে প্রচুর ধাতব পদার্থ রয়েছে, বিশেষ করে এলকালী ধাতু। ক্লোরিনের সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি সংগ্রহের একটি সহজ পদ্ধতি। পৃথিবীর প্রাণিজগৎ যেরকম পুরোপুরি ডি. এন. এ. নির্ভর এখানে সেরকম কিছু দেখা গেল না, দীর্ঘ সুতার মতো ক্রিস্টালের অবকাঠামো রয়েছে যার ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত যেতে পারে। মাঝে মাঝে গোলাকার অংশে গেলিয়াম৩১ এবং আর্সেনাইডের প্রাচুর্য দেখা গেল, সম্ভবত বৈদ্যুতিক সঙ্কেত বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাণীটির দেহ থেকে বের হওয়া তরল থেকে আরো নানা ধরনের অসংখ্য তথ্য দেওয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই অল্প সময়ে বোঝার কোনো উপায় নেই। ঠিক কোন অংশটি ব্যবহার করে এটি চতুর্মাত্রিক জগতে বিচরণ করতে পারে সেই তথ্যটুকু খুঁজে পাওয়া গেল না।
ত্রালুস বিশাল তথ্যভাণ্ডারের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইরনকে জিজ্ঞেস করল, ইরন, তুমি বুঝতে পারলে?
পুরোপুরি বুঝতে সময় নেবে। তবে যেটুকু বোঝার সেটুকু বুঝেছি।
কী বুঝেছ?
এটি চতুর্থমাত্রায় বিচরণ করতে পারে সত্যি কিন্তু এটি তৈরি আমাদের পরিচিত পদার্থ দিয়ে। যার অর্থ– ইরন একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা প্রয়োজন হলে আমাদের প্রযুক্তি দিয়েই তার সামনাসামনি হতে পারব।
শুমান্তি একটু হেসে বলল, তুমি বলতে চাইছ প্রয়োজন হলে আমাদের অস্ত্র দিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে।
ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি এটা বলতে চাইছি না–বোঝাতে চাইছি। প্রথমবার যখন কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে দেখা হয় তখন তাদের সাথে যুদ্ধ করার কথা নয়!।
ত্রালুস স্কাউটশিপের সামনে থেকে উচ্চকণ্ঠে বলল, তোমরা তোমাদের নিজেদের জায়গায় বস, কীশার স্কাউটশিপটা পাওয়া গেছে, আমরা এখন নামব।
কিছুক্ষণের মাঝেই স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করতে শুরু করে। আয়োনিত গ্যাসের আলোতে হঠাৎ করে চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে।
৩.৩ স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন
স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন, ত্রাস এবং শুমান্তি মহাকাশযান থেকে নিয়ে আসা দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুটগুলো পরে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হাওয়ায় এই স্পেসস্যুট দিয়ে যথার্থ নিরাপত্তা পেতে হলে তার বিভিন্ন স্তরকে সক্রিয় করতে হবে, কাজটি জটিল এবং শ্রমসাপেক্ষ। মহাকাশযানে এই ধরনের কাজে সাহায্য করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, স্কাউটশিপে পুরোটুকুই নিজেদের করতে হয়।
অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সঠিক মিশ্রণ পরীক্ষা করে ক্ষুদ্র প্যালেটগুলো সিলিন্ডারে রেখে বাইরে নিশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থাটুকু নিশ্চিত করতে করতে ত্রানুস ইরনের কাছে এগিয়ে যায়।
ইরন।
বল।
আমি তোমার চতুর্মাত্রিক প্রাণীর ব্যাপারটি বুঝতে পারি নি। আমরা যেখানে বড় হয়েছি সেখানে বিজ্ঞান শেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এর মাঝে বিজ্ঞান খুব বেশি নেই। সত্যি কথা বলতে কী বিজ্ঞান বেশি শিখে নিলে মস্তিষ্ক খানিকটা রুটিনের মাঝে চলে আসে, তখন প্রচলিত নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, শুমান্তিকে যার ক্রোমোজম৩ দিয়ে ক্লোন করা হয়েছে সে নিশ্চয়ই বড় বিজ্ঞানী ছিল, বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো তাই সহজে বুঝে ফেলে। আমি পারি না।
শুমান্তি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ। আমিও লক্ষ করেছি।
ব্যাপারটা আমাকে বোঝাতে পারবে?
চেষ্টা করতে পারি। ইরন খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করে বলল, প্রাচীনকালে তথ্য আদান–প্রদান করার জন্য এক ধরনের জিনিস ব্যবহার করা হত, তার নাম ছিল বই। কাগজ নামের পাতলা এক ধরনের পরদার মতো জিনিসে লিখে অনেকগুলো একসাথে বেঁধে রাখা হত। তুমি কি সেগুলো কখনো দেখেছ?
না। সামনাসামনি দেখি নি। হলোগ্রাফিক ছবি দেখেছি।
চমৎকার। মনে করা যাক এই বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা হচ্ছে একেকটি ত্রিমাত্রিক জগৎ। মনে করা যাক আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ হচ্ছে এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা। আমরা, মানুষেরা শুধুমাত্র এই পৃষ্ঠায় বিচরণ করতে পারি, এর বাইরে যেতে পারি না। মনে কর আমরা ছোট পিপড়ার মতো এই বইয়ের পৃষ্ঠায় ঘুরে বেড়াই। এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা থেকে এক শ বারো নম্বর পৃষ্ঠায় যেতে হলে পুরো পৃষ্ঠা পার হয়ে বইয়ের শেষ মাথায় এসে ঘুরে এই নতুন পৃষ্ঠায় যেতে হবে–বলতে পার বিশাল দূরত্ব পার হতে হবে।
আমরা এই মহাকাশযানে করে এ রকম একটা বিশাল দূরত্বে চলে এসেছি তবে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে আসি নি, ওয়ার্মহোল তৈরি করে এসেছি। ওয়ার্মহোল হচ্ছে পৃষ্ঠা ফুটো করে চলে আসার মতো–বইয়ের পৃষ্ঠায় একটা ছোট ফুটো করলেই এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় চলে যাওয়া যায়, এটাও সেরকম।
এখন মনে করা যাক এই বইয়ের মাঝে অন্য এক ধরনের কীট এসেছে। সে বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে কেটে যেতে পারে। আমাদের কাছে এই পোকাকে মনে হবে চতুর্মাত্রিক প্রাণী। কারণ এরা সহজেই বইয়ের ভিতর দিয়ে একটার পর অন্য একটা জগতের মাঝে চলে যেতে পারে। এরা যখন আমাদের জগতের ভিতর দিয়ে অর্থাৎ আমাদের পৃষ্ঠার ভিতর দিয়ে যাবে আমরা তখন তাদের দেখব কিন্তু শুধু আমাদের পৃষ্ঠার অংশটুকুই। তার প্রকৃত রূপ আমরা কখনো দেখব না, কখনো জানব না।