কীশার স্কাউটশিপটা নিচে নেমে গেছে। ত্রালুসের গলার স্বর শুনে ইরন মাথা তুলে তাকাল।
কেমন করে বুঝতে পারলে?
খুব ঝড়ো হাওয়া হচ্ছে তাই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সিগনালে আর ডপলার শিফট নেই। স্কাউটশিপটা থেমে গেছে।
আমাদেরও কাছাকাছি থামতে হবে।
ঠিক আছে। নিচে নেমে আমি একবার ঘুরে আসি।
বেশ।
স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এর মাঝে ত্রাসের নিজের মাঝে বেশ একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সে বেশ সাবলীলভাবে স্কাউটশিপটাকে ঘুরিয়ে নিচে নামিয়ে নিতে থাকে। বাইরে গাঢ় সবুজ রঙের মেঘ কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠে আসছে, তার মাঝে নীলাভ বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ খেলা করছে। নিচে বেগুনি রঙের প্রান্তর, কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার। মাঝে মাঝে বড় বড় ফাটল, তার ভিতর থেকে ঈষৎ কমলা রঙের এক ধরনের আলো বের হয়ে আসছে। পুরো দৃশ্যটি একটি অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের মতো, তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে মনে হয় এর কোনোটিই সত্যি নয়, পুরোটুকু বুঝি শক্তিশালী কোনো মস্তিষ্ক–বিকলন ড্রাগের ফল। ইরন জানালা থেকে মাথা ঘুরিয়ে ভিতরে তাকাল এবং হঠাৎ করে স্কাউটশিপের ভিতরে আবার সেই ভয়াবহ কদাকার প্রাণীটিকে দেখতে পেল। কোনো বীভৎস প্রাণীকে যেন কেউ খুলে তার ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাইরে নিয়ে এসেছে।
স্কাউটশিপের ভিতরটুকু তীক্ষ্ণ ঝুঁজালো গন্ধে ভরে গেল–আঠালো চটচটে তরল প্রাণীটির দেহ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে স্কাউটশিপের ভিতর গড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রাণীটি থরথর করে কাঁপছে। ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরসর করে নড়ছে। ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে বীভৎস প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে একটা জিনিস বুঝতে পারে, সে ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠে বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইরন শুমান্তির আর্তচিৎকার শুনতে পেল। ত্রালুস ছুটে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে ইরনের পাশে এসে দাঁড়ায়। ভয়ঙ্কর দর্শন প্রাণীটি থেকে হঠাৎ করে গুঁড়ের মতো কিছু একটা ছুটে আসে, ত্রালুস অস্ত্রটি উঁচু করে ধরতেই ইরন খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, না, ত্রালুস, না।
এটা তোমাকে আক্রমণ করছে।
আমার ধারণা করছে না।
তা হলে কী করছে?
কিছুই করছে না।
ত্রালুস নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং থলথলে ভেজা আঠালো ঔড়গুলো তাদের গা ঘেঁষে গিয়ে হঠাৎ করে প্রাণীটির শরীরে মিশে গেল।
শুমান্তি হেঁটে ইরনের পাশে এসে দাঁড়াল, নিচু গলায় বলল, তুমি কেন বলছ এটা কিছুই করছে না?
কারণ এটা আমাদের দেখছে না।
দেখছে না?
না।
কেন দেখছে না, এর কোনো চোখ নেই?
না, চোখ–কানের কথা নয়। অন্য কোনো ধরনের প্রাণী হলেই যে চোখ–কান থাকতে হবে তা ঠিক নয়, তারা অন্য কোনোভাবেও তাদের তথ্য নিতে পারে।
তা হলে?
এটি একটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী। ত্রিমাত্রায় কিছু থাকলে সেটি এত সহজে সেটা দেখতে পারে না।
চতুর্মাত্রিক প্রাণী?
হ্যাঁ। শুধুমাত্র চতুর্মাত্রিক প্রাণীই ত্রিমাত্রিক জগতে হঠাৎ করে হাজির হতে পারে, হঠাৎ করে অদৃশ্য হতে পারে। এরা চতুর্মাত্রিক প্রাণী বলেই চতুর্থমাত্রা ব্যবহার করে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিল।
হ্যাঁ, আমরা ত্রিমাত্রিক জগতে এই প্রাণীটির প্রজেকশনটুকু দেখছি। প্রাণীটি দেখতে আসলে কী রকম আমরা কোনোদিন জানতে পারব না।
ত্ৰালুস অস্ত্রটি তাক করে রেখে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি নিশ্চিত এটা আমাদের দেখতে পারছে না?
পুরোপুরি নিশ্চিত কেমন করে হব? কিন্তু আমার ধারণা এটা আমাদের দেখতে পাচ্ছে। যদি দ্বিমাত্রিক একটা জগৎ থাকত তা হলে আমরা যেরকম দেখতে পেতাম না অনেকটা সেরকম।
শুমান্তি বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটার দ্রুত পাল্টে যাওয়া বীভৎস দেহটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন আমরা দ্বিমাত্রিক জগৎ দেখতে পেতাম না?
কারণ একটি ত্রিমাত্রিক জগতে অসীম সংখ্যক দ্বিমাত্রিক জগৎ থাকে, কোনটি তুমি দেখবে? শুধু একটি হলে তুমি দেখবে, কিন্তু একটি তো নেই, কোনটা তুমি আলাদা করে দেখবে?
ত্রালুস অস্ত্রটি আলগোছে ধরে রেখে বলল, তুমি বলছ আমি যদি এটাকে গুলি করি এটা জানবে না কে তাকে গুলি করেছে?।
সম্ভবত জানবে না, কিন্তু বুঝতে পারবে, কোনো একটি ত্রিমাত্রিক জগতে সে আঘাত পেয়েছে। চতুর্মাত্রিক প্রাণী তখন ত্রিমাত্রার জগৎকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারে।
শুমান্তি আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, এটা আসলে তার আকার পরিবর্তন করছে না। এটা আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। যখন যেটুকু আমাদের জগতে রয়েছে তখন সেটুকু আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এইজন্য এটা হঠাৎ করে এখানে আসতে পারে, আবার হঠাৎ করে চলে যেতে পারে।
ইরনের কথা শেষ হবার আগেই অদৃশ্য একটা আলোকের ঝলকানি দেখা গেল এবং হঠাৎ করে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ইরন মাথা নেড়ে বলল, একটা বদ্ধ জায়গায় কোনো জিনিস হঠাৎ করে আসা এবং হঠাৎ করে বের হয়ে যাওয়ার একটি মাত্র ব্যাখ্যা, এটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী।
ত্রালুসকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখায়। সে শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মনে হয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ। আমি এখনো বুঝতে পারি নি।
ইরন ত্রালুসের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব, আগে দেখ মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র বিশ্লেষণ করে নতুন কিছু পাঠিয়েছে কি না।