প্রাণীটি দেয়াল আঁকড়ে ধরে একটি ছোট ফুটো দিয়ে বাতাস বের হয়ে যাবার মতো এক ধরনের অনিয়মিত শব্দ করতে থাকে, সমস্ত স্কাউটশিপে চটচটে আঠালো গাঢ় বাদামি রঙের এক ধরনের তরল ছিটকে ছিটকে পড়ে।
ত্রালুস স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে ভল্টের দিকে ছুটে গেল, ঢাকনা খুলে তার ভিতর থেকে একটা ভয়াবহ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে এল। প্রাণীটির দিকে অস্ত্র তাক করতেই ইরন নিচু গলায় বলল, খবরদার। গুলি কোরো না।
ঠিক আছে। এলুস একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, কিন্তু আবার যদি আমাদের আক্রমণ করে?
করলে দেখা যাবে। এখনো তো করে নি।
ওরা তিন জন স্কাউটশিপের মেঝেতে উঁচু হয়ে বসে প্রাণীটির দিকে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইল। এটি দেখলে প্রথমেই যে জিনিসটি মনে হয় সেটি হচ্ছে যে জীবন্ত কোনো একটি প্রাণীর চামড়া ছিলে ফেলা হয়েছে, এখন হঠাৎ করে ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছে। থলথলে ভেজা আঠালো জিনিস নড়ছে, এবং কিলবিল করছে। এর নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। প্রথমে একটা বড় অক্টোপাসের মতো দেয়াল আঁকড়ে ধরে রইল এবং সেই অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে থাকে। ছোট ছোট পুঁড়ের মতো জিনিস ঝুলতে থাকে এবং সেগুলো হঠাৎ করে বুজে যায়। জিনিসটি স্কাউটশিপের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে একটু ছোট হয়ে আসে, তীব্র আলোর একটা ঝলকানি হল এবং হঠাৎ করে প্রাণীটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইরন হতচকিতের মতো স্কাউটশিপের ভিতরে তাকায়, এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে জলজ্যান্ত এ রকম একটা প্রাণী তাদের চোখের সামনে থেকে এভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। ত্ৰালুস শক্ত করে অস্ত্রটি ধরে রেখে কয়েক পা এগিয়ে গেল, এদিক–সেদিক তাকিয়ে বলল, কোথায় গেছে?
শুমান্তি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শরীরের নানা জায়গায় লেগে থাকা কুৎসিত চটচটে আঠালো তরলের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, চলে গেছে।
কিন্তু কেমন করে চলে গেল?
তা হলে আগে জিজ্ঞেস কর কেমন করে ভিতরে এল?
ত্রালুস বিভ্রান্তের মতো শুমান্তির দিকে তাকাল, মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ, কেমন করে ভিতরে এল?
শুমান্তি এক টুকরো নিও পলিমারের টুকরো নিয়ে শরীরের নানা জায়গায় লেগে থাকা আঠালো তরল মুছতে মুছতে বলল, এটাই কি সেই বুদ্ধিমান প্রাণী?
ইরন চিন্তিত মুখে স্কাউটশিপের ভিতরে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে বলল, মনে হয়।
শুমান্তি বলল, আমার তো এটাকে বুদ্ধিমান মনে হল না। কদাকার মনে হল।
সৌন্দর্যের ধারণা খুব আপেক্ষিক। মাকড়সা যদি আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী হত তা হলে তারা মানুষকে খুব কদাকার প্রাণী বলে বিবেচনা করত।
ত্রালুস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ভল্টের ভিতরে রাখতে রাখতে বলল, প্রাণীটি অন্তত আমাদেরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে নি।
হ্যাঁ। অন্তত আমরা বুঝতে পারি নি।
শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, এটি যদি সত্যি সত্যি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তা হলে আমি ভয়েই মারা যেতাম।
ইরন অন্যমনস্কের মতো বলল, হুঁ।
শুমান্তি স্কাউটশিপের ঝাঁকুনির মাঝে সাবধানে সামনের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ইরন।
ইরন কোনো কথা বলল না, খুব চিন্তিতভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
শুমান্তি কাছে গিয়ে বলল, ইরন।
ইরন একটু চমকে উঠে বলল, কী হল?
তুমি কী ভাবছ?
না, আমি জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করছি। একটা রক্তমাংসের প্রাণী—
রক্তমাংসের? শুমান্তি মুখ বিকৃত করে বলল, রক্তমাংস?
দেখে তো সেরকমই মনে হল। স্কাউটশিপে যে তরলগুলো ছিটিয়েছে তার নমুনা মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলে বিশ্লেষণ করে বলতে পারবে। আমার মনে হয় আমরা দেখব এটা জীবিত কোনো প্রাণীর দেহ থেকে এসেছে।
শুমান্তি শরীর থেকে চটচটে তরল মোছার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের শরীরে লেগে গেছে, কোনো ক্ষতি হবে না তো?
এখনো যখন হয় নি, মনে হয় আর হবে না। যেহেতু এটা ভিন্ন ধরনের প্রাণীসত্তা, আমার মনে হয় না আমাদের শরীরকে আক্রমণ করতে পারবে। ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার মতো এটা তো নিশ্চয়ই আর. এন. এ, ডি. এন. এ দিয়ে তৈরি নয়। তাদের নিজস্ব জিনিস দিয়ে তৈরি। ঘরে কেমন কাঁজালো কটু গন্ধ দেখেছ?
কিসের গন্ধ এটা?
মনে হয় ক্লোরিনের। আমরা যেরকম অক্সিজেন দিয়ে নিশ্বাস নেই, এটা মনে হয় সেরকমভাবে ক্লোরিন দিয়ে নিশ্বাস নেয়!।
ক্লোরিন? কিন্তু সেটা তো ভয়ঙ্কররকম বিক্রিয়াশীল গ্যাস।
ইরন হেসে ফেলল, বলল, অক্সিজেনও অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল গ্যাস। লোহার মতো ধাতুকে সেটা আক্রমণ করে ক্ষয় করে ফেলে। কিন্তু আমরা তার মাঝে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারি।
সেটা ঠিক বলেছ, আমি আগে কখনো এভাবে চিন্তা করি নি।
ত্রালুস স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে ছোট স্ক্রিনটার উপর ঝুঁকে পড়ল। সাবধানে স্কাউটশিপটাকে আবার নিচে নামাতে শুরু করে। বাতাসের ঘনত্ব আরো বেড়েছে–বাইরে এখন ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলি পাকানো সবুজ মেঘ ভেসে যাচ্ছে, প্রতিবার এ রকম একটা মেঘে আঘাত করা মাত্র স্কাউটশিপটি থরথর করে কেঁপে উঠছিল। বহু নিচে স্থানে স্থানে বেগুনি রঙের উঁচুনিচু ভূমি। সেখানে কী বিস্ময় লুকিয়ে আছে কে জানে।
ইরন স্কাউটশিপের গোলাকার জানালার সামনে বসে আবার বাইরে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গেল। একটি প্রাণী কীভাবে বন্ধ স্কাউটশিপে এসে হাজির হতে পারে আবার কীভাবে বন্ধ স্কাউটশিপ থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? এটি তো অলৌকিক কিছু হতে পারে না, বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো নিশ্চয় মানতে হবে। কোনো জিনিস তো হঠাৎ করে সৃষ্টি হতে পারে না, আবার এ রকম হঠাৎ করে অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে না। প্রাণীটি কোথায় গেল?