ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই হতে পারে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ রকম আরো এক হাজারটি সম্ভাবনা থাকতে পারে–আমরা কোনটাকে সত্যি বলে ধরে নেব?।
ইরন বলল, আমরা এখন কোনো বিচার–বিবেচনা–বিশ্লেষণে যাব না। আমরা আগের স্কাউটশিপটার পিছনে পিছনে যাব। যদি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে তা হলে নিশ্চয়ই কীশার সাথে দেখা করে নিশিকে নিতে আসবে।
শুমান্তি জানালা দিয়ে নিচে গ্রহটির দিকে তাকিয়ে বলল, কী মন–খারাপ–করা একটি জায়গা!
শুমান্তির কথা শেষ হবার আগেই স্কাউটশিপটা একটা বড় ঝাঁকুনি খেল, ভিতরে একটা লাল আলো জ্বলে ওঠে এবং কর্কশ স্বরে সতর্কসূচক এলার্ম বাজতে শুরু করে। শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?
ত্রালুস স্কাউটশিপটার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে করতে বলল, এতক্ষণ বাতাসহীন অবস্থায় ছিলাম বলে সহজে নেমে এসেছি। এখন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছি। তোমাদের আরো ঝাঁকুনি সহ্য করতে হবে।
ইরন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, সত্যি সত্যি বাইরের অন্ধকার আকাশকে হালকাভাবে আলোকিত দেখা যাচ্ছে। স্কাউটশিপের দুই পাশে বাতাসে ওড়ার জন্য দুটি ফিন বের হয়ে এসেছে। ফিন দুটিকে ঘিরে বেগুনি রঙের এক ধরনের আলো দেখা গেল, বাতাসের ঘর্ষণে তৈরি হচ্ছে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসছে, গ্রহটির বায়ুমণ্ডল নিশ্চয়ই অত্যন্ত সক্রিয়।
এতক্ষণ মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে স্কাউটসজিপটি নিচে নেমে এসেছে, গ্রহটির কাছাকাছি পৌঁছে যাবার কারণে এখন তার গতিবেগ কমিয়ে আনার প্রয়োজন হল। লুস আবার স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিনটি চালু করে দেয়, সাথে সাথে ভয়ঙ্কর শব্দ করে স্কাউটশিপটি থরথর করে কাঁপতে থাকে। স্কাউটশিপটি প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় নিচে নামতে থাকে, শক্ত করে বাঁধা না থাকলে স্কাউটশিপের ভিতরে সবাই বড় ধরনের আঘাত পেয়ে যেত। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কি ঠিকভাবে নামছি?
ত্রালুস ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে উঁচু গলায় বলল, ঠিকভাবে কি না জানি না, কিন্তু নামছি!
ইরন বলল, শুধু নামলেই হবে না। কীশা যেখানে নেমেছে, সেখানে নামতে হবে।
হ্যাঁ। কীশার স্কাউটশিপের সিগন্যালকে এই স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ মডিউল লক করে নিয়েছে। এখন সেটার পিছু পিছুই যাচ্ছে।
চমৎকার।
শুমান্তি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণহীন ঝাঁকুনি সহ্য করতে করতে বলল, কীশা স্কাউটশিপটিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?
গ্রহটির মাঝামাঝি একটা জায়গায়। মনে হচ্ছে একটু উঁচু পাথুরে জায়গা।
অন্য কোনো বিশেষত্ব আছে জায়গাটার?
ত্রালুস খানিকক্ষণ স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে বলল, না নেই। শুধু—
শুধু?
শুধু এর আশপাশে অবলাল আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।
ইরন আবার ভুরু কুঁচকে জানালা দিয়ে নিচে তাকাল। সবুজ এবং বেগুনি রঙের এই কুৎসিত গ্রহটিতে তারা নামতে যাচ্ছে, সেখানে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তারা জানে না। নিনীষ স্কেলে পঞ্চম শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তার একটি প্রাণী তাদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করবে কে জানে? ইরনের বুকের ভিতরে একটা অশুভ চাপা আশঙ্কা পাক খেতে শুরু করে। সে তখন মুখ তুলে ত্রালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, দুজন হাসিখুশি তরুণ–তরুণী। মনে হয় এই দুজনই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছে–তাই এত সহজে এই ভয়ঙ্কর অভিযানে রওনা দিয়েছে, যে অভিযান থেকে বেঁচে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ইরন জোর করে তার ভিতরকার সকল চাপা ভয় এবং অশান্তিকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সত্যিই তো–বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই হিসেবে তারা কত ক্ষুদ্র একটি সময় বেঁচে আছে! এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়টুকু একটু বেশি বা একটু কম হলে কী ক্ষতি–বৃদ্ধি হতে পারে? তার পরিবর্তে যদি একটি প্রাণীকেও অল্প কিছু ভালবাসা দেওয়া যায় সেটাই কি বড় কথা নয়?
ইরন যখন সত্যি সত্যি পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নিজের ভিতরে এক ধরনের আনন্দময়। অনুভূতি প্রায় সৃষ্টি করে ফেলেছে ঠিক তখন সে শুমান্তির একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেল।
ইরন মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল শুমান্তির সামনে শূন্য থেকে একটি বীভৎস কদাকার জিনিস ঝুলছে।
৩.২ ইরন চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে
ইরন চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্কাউটশিপের মাঝ দিয়ে শুমান্তির কাছে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল, ঠিক সেই মুহূর্তে স্কাউটশিপটা একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে পুরোটা প্রায় উল্টে যেতে যেতে কোনোমতে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ইরন দেয়াল আঁকড়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, স্কাউটশিপের এক কোনায় গিয়ে ছিটকে পড়ে। কোনো রকমে আবার সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর মেঝেতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে শুমান্তির কাছাকাছি গিয়ে হাজির হল।
যে জিনিসটি তাদের সামনে ঝুলছে এর থেকে কদাকার কিছু তারা কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। জিনিসটি জীবন্ত সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, এর ভিতরে নানা অংশ নড়ছে, কিলবিল করছে, পুরো জিনিসটি সরসর শব্দ করে হঠাৎ বড় হতে শুরু করল। জিনিসটি থেকে উড়ের মতো কিছু একটা বের হয়ে এল, হঠাৎ করে গোলাপি রঙের চটচটে ভেজা জিনিসটি তাদেরকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই ইরন শুমান্তিকে নিয়ে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। জিনিসটি আবার নড়তে শুরু করে এবং হঠাৎ করে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, শুমান্তি আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং ইরন আবার তাকে ধরে নিচে লাফিয়ে পড়ল, ভেজা থলথলে জীবন্ত জিনিসটি তাদের উপর দিয়ে স্কাউটশিপের অন্যদিকে যেতে শুরু করে, ঠিক তাদের উপর দিয়ে যাবার সময় টপটপ করে তাদের উপর চটচচে এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়ল। ঝাজালো কটু এক ধরনের দৃষিত গন্ধে হঠাৎ করে স্কাউটশিপের বাতাস ভারী হয়ে আসে। তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শুমান্তি নিশ্বাস নেবার। চেষ্টা করে কাশতে শুরু করে।