শুমান্তি বাধা দিয়ে বলল, হাসিখুশি না বদরাগী?
ইরন বলল, তার মানে তুমি ধরে নিয়েছ এদের আমাদের মতো অনুভূতি রয়েছে? কখনো হাসিখুশি থাকে কখনো রেগে থাকে?
আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু যেহেতু বুদ্ধিমানের একটা পরিমাপ করা হয়েছে। মস্তিষ্কের মতো কিছু একটা নিশ্চয়ই থাকবে–যেখানে সব তথ্য বিশ্লেষণ করবে।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে তুমি ধরে নিয়েছ তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়াটি আমাদের মতো? নিউরন সেল থাকবে, সিনাল থাকবে, তার ভিতর যোগাযোগ হবে সঙ্কেত আদান–প্রদান হবে?
শুমান্তি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি জানি না। মানুষ ছাড়া যেহেতু আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী দেখি নি, তাই মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর কথা মনে হলেই কেন জানি মনে হয় সেটা মানুষের মতোই হবে। হাত–পা থাকবে, নাক–মুখ, চোখ থাকবে–তবে সেটা হবে খুব ভয়ঙ্কর! হয়তো মস্তিষ্কটা শরীরের বাইরে, চোখগুলো সাপের মতো, হয়তো খুব নিষ্ঠুর!
ইরন একটু হেসে বলল, আমাদের সেটাই হয়েছে সমস্যা! আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের বাইরে চিন্তা করতে পারি না। হয়তো এই প্রাণীর সাথে আমাদের কোনো মিল নেই। হয়তো এটার ঘনত্ব এত কম যে আমরা দেখতে পাই না! কিংবা আসলে পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী। কিংবা প্রাণীটা পদার্থের নয়, প্রাণীটা শক্তির। আলো বা বিদ্যুৎ বা যান্ত্রিক শক্তি! কত কিছু হতে পারে!
শুমান্তি বলল, ইরন, তুমি যেভাবে বলছ, শুনে আমার তো একটু ভয়ই লাগছে।
ভয়? ইরন হেসে বলল, আমাদের কেন জানি ভয় থেকে বেশি হচ্ছে কৌতূহল। প্রাণীটি দেখতে কী রকম? বিশাল মস্তিষ্কসহ কিলবিলে অক্টোপাসের মতো কোনো প্রাণী, নাকি এমন একটি প্রাণী যার অস্তিত্ব আমরা কল্পনাও করতে পারি না!
ত্রালুস বলল, হয়তো একটু পরেই দেখব।
হয়তো।
ত্রালুস কন্ট্রোল প্যানেলের সবকিছু দেখে বলল, তা হলে কি শুরু করব?
হ্যাঁ। শুরু করা যাক।
ত্রালুস সুইচ স্পর্শ করামাত্রই প্রচণ্ড একটা শব্দ করে স্কাউটশিপটি থরথর করে কেঁপে উঠল। খানিকক্ষণ তার শক্তিশালী ইঞ্জিনটি থেকে আয়োনিত গ্যাস বের হতে থাকে, ভিতরে একটা সতর্ক ধ্বনি শোনা গেল এবং হঠাৎ করে পুরো স্কাউটশিপটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
স্কাউটশিপটা মহাকাশযানকে ঘিরে একবার ঘুরে আসে, মহাকাশযানটি যে কত বিশাল সেটি আবার নতুন করে সবার মনে পড়ল। নিচে গা ঘিনঘিন করা গ্রহটির মহাকর্ষ বলে মহাকাশযানটি স্থিতি হয়েছে, প্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটারব্যাপী একটি কক্ষপথ নিয়ে এখন সেটি এই গ্রহটাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মহাকাশযানটির নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতে নেই, এই গ্রহটিকে কেন্দ্র করে বিশাল একটি কক্ষপথ নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটিও পূর্বনির্ধারিত।
স্কাউটশিপটি মহাকাশযান থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে, চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। দূরে কোনো একটি আলোকিত নেবুলা থেকে নীলাভ এক ধরনের আলো এসে এই গ্রহটাকে আলোকিত করছে। এই আলোতে সবকিছুকেই অতিপ্রাকৃত মনে হয়, এই গ্রহটিকে শুধু অতিপ্রাকৃত নয় অশুভ বলে মনে হতে থাকে।
ইরন স্কাউটশিপের গোলাকার জানালা দিয়ে নিচে গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, এই গ্রহটা সম্পর্কে তথ্যগুলো এনেছ?
হ্যাঁ। ত্রালুস একটা সুইচ টিপে দিতেই তার সামনে আরো একটা ছোট স্ক্রিন বের হয়ে এল। স্ক্রিন থেকে তথ্যগুলো সে পড়ে শোনাতে থাকে, গ্রহটির ব্যাসার্ধ ছয় হাজার কিলোমিটার, এর ভর পৃথিবীর দেড়গুণ। গ্রহটির এক ধরনের বায়ুমণ্ডল রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের বেশিরভাগ কার্বন–ডাই অক্সাইড। অল্প পরিমাণ ক্লোরিন এবং মিথেন রয়েছে। গ্রহের পৃষ্ঠদেশে বাতাসের চাপ বারশত মিলিবার। বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ হচ্ছে সত্তর থেকে দুইশত কিলোমিটার। গ্রহটির পৃষ্ঠদেশ এক ধরনের নরম পদার্থের তৈরি, স্থানে স্থানে তরল পদার্থ থাকতে পারে। তরল পদার্থের পি. এইচ. তিনের কাছাকাছি। মানুষের জন্য গ্রহটি বাসযোগ্য নয়–অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। গ্রহটি কাছাকাছি একটি নেবুলা দিয়ে আলোকিত হচ্ছে। গ্রহটির নিজস্ব কিছু আলোর উৎস রয়েছে, আলোর বেশিরভাগ অবলাল, খালি চোখে ধরা পড়ে না।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি গ্রহটির যে বর্ণনা দিয়েছ, শুনে মনে হচ্ছে ফিরে যাই, গিয়ে আর কাজ নেই।
ঠিকই বলেছ।
এখানে যদি সত্যিই বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে তা হলে তার কোনো চিহ্ন থাকা উচিত। সেই চিহ্ন কি দেখা যাচ্ছে?
ত্রালুস আবার স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করে স্ক্রিনটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে বলল, না। সভ্যতার চিহ্ন বলতে আমরা যা বোঝাই সেরকম কিছু নেই। কোনো দালানকোঠা রাস্তাঘাট বা শক্তি কেন্দ্র সেরকম কিছু নেই।
ইরন অবাক হয়ে বলল, কিছু নেই?
না, কিছু নেই। শুধু
শুধু?
শুধু মাঝে মাঝে কোনো কোনো স্থান থেকে অবলাল আলোর একটা বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। পুরোপুরি সামঞ্জস্যহীন বিচ্ছিন্ন অবলাল আলোর বিচ্ছুরণ।
হুঁ। ইরন ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে। সত্যি সত্যি যদি এই গ্রহটি বুদ্ধিমান প্রাণীদের গ্রহ হয়ে থাকে তা হলে তার কোনো চিহ্ন কি দেখা যাওয়ার কথা নয়?
শুমান্তি ইতস্তত করে বলল, হয়তো এই গ্রহটা ফাঁপা, হয়তো প্রাণীগুলো গ্রহটার ভিতরে থাকে।