নিশি। তুমি এখন আর সাধারণ মানুষ হতে পারবে না। সাধারণ মানুষের সবকিছু হয় সাধারণ। তাদের আত্মত্যাগ হয় সাধারণ। তাদের অবদানও হয় সাধারণ। তুমি একজন অসাধারণ মানুষ, তোমার আত্মত্যাগ হতে হবে অসাধারণ, সেরকম তোমার অবদানও হবে অসাধারণ।
নিশি নামের কিশোরীটি তবুও আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
শান্ত হও নিশি। তুমি জান তোমাকে শান্ত হতেই হবে।
নিশি ধীরে ধীরে মুখ তুলে কীশায় দিকে তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল। ইরন মেয়েটির দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিশি এবারে তালুসের দিকে তাকাল, জালুস তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে মাথা নিচু করল। নিশির চোখে–মুখে এক ধরনের অসহায় ভাব ফুটে ওঠে। সে অনেক আশা নিয়ে শুমান্তির দিকে তাকাল, শুমান্তি কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। নিশি হঠাৎ করে। হাল ছেড়ে ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার চোখ–মুখের ব্যাকুল অসহায় ভাব কেটে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। সে চোখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, এ রকম করে বিচলিত হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আর বিচলিত হব না। বল আমাকে কী করতে হবে?
চমৎকার! কীশা মিষ্টি করে হেসে বলল, চল আমার সাথে।
নিশি আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। পাতলা এক ধরনের নিও পলিমারের কাপড় তার ছিপছিপে কিশোরী দেহকে ঢেকে রেখেছে। জীবন রক্ষাকারী যন্ত্র থেকে বাতাস বের হচ্ছে, সেই বাতাসে নিশির চুল উড়ছে। দেহের কাপড় উড়ছে, সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে এ দৃশ্যটি কেন জানি এক গভীর বেদনায় ইরনের বুক ভেঙে ফেলতে চায়। অনিন্দ্যসুন্দরী এই কিশোরীটি যেন পৃথিবীর কোনো প্রাণী নয় যেন স্বর্গ থেকে কোনো দেবী নেমে এসেছে। ইরন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, দেখতে পেল কীশা হাত ধরে স্বর্গের এই দেবীকে নিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক মিনিট পর তারা স্কাউটশিপের গর্জন শুনতে পায়, মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপে করে কীশা গা ঘিনঘিন করা সবুজ এবং বেগুনি রঙের গ্রহটিতে নেমে যাচ্ছে। গ্রহটি যেন নরক। স্বর্গ থেকে নেমে আসা একটি দেবীকে সেই নরকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। তাদের কারো কিছু করার নেই, পুরো ব্যাপারটি অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
.
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ইরন মাথা নিচু করে দুই হাতে তার মাথার চুল আঁকড়ে বসে আছে। তার সামনে কাছাকাছি এলুস এবং শুমান্তি। ইরন একসময় মাথা তুলে তাকাল, একবার ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, আমরা কী করতে পারি বলবে?
ত্ৰালুস এবং শুমান্তি কিছু বলল না, ইরন আবার বলল, আমাদের কি কিছু করার আছে?
এবারেও ত্রাস আর শুমান্তি চুপ করে রইল। ইরন হাত দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বলল, ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়েকে পৃথিবী থেকে ধরে এনেছে এখানকার প্রাণীদের হাতে তুলে দেবার জন্য; বিশ্বাস করতে পার তোমরা? অথচ পুরো ব্যাপারটি আমাদের দেখতে হল, আমরা একটা কিছু করতে পারলাম না। ইরন ভাঙা গলায় বলল, আমি সারা জীবনে এ রকম অসহায় অনুভব করি নি!
শুমান্তি ইতস্তত করে বলল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি? তুমি যদি কিছু মনে না কর।
ইরন শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এই কথাটি নিশিকেও বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরিবেশটি এত ভয়ঙ্কর ছিল যে তখন কিছু বলতে পারি নি।
তুমি নিশিকে কী বলতে চেয়েছিলে
আমি তাকে বলতে চেয়েছিমান, নিশি তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমরা তোমাকে উদ্ধার করে আনব।
ইরন চমকে উঠে শুমান্তির দিকে তাকাল, মেয়েটির মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে উদ্ধার করে আনবে?
আমি জানি না।
তা হলে?
তা হলে কী?
তা হলে কেন নিশিকে বলবে যে একে উদ্ধার করে আনবে?
শুমান্তি একটু অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকাল, তাকে দেখে মনে হল এত সহজ একটি জিনিস ইরন বুঝতে পারছে না দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। সে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের কাছে তো নিশি সেটাই শুনতে চেয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা তো সেটা করতে পারব না।
আমরা তো চেষ্টা করতে পারি।
চেষ্টা করব? ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি জান চেষ্টা করলে কী হবে? তুমি দেখেছ আমাকে কীভাবে কীশা গুলি করেছিল?
শুমান্তি এবারে একটু লজ্জা পেয়ে গেল, সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বলল, হ্যাঁ, সেটা অবশ্য সত্যি। চেষ্টা করলে আমরা নিশ্চয়ই মারা পড়ব। কিন্তু আমরা যদি চেষ্টা
করি তা হলে নিশি মেয়েটির মানুষের ওপর বিশ্বাস তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে।
ইরন ছটফট করে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ শুমান্তি। নিশি মেয়েটি যেন মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখে সে জন্য সবাই মারা পড়বে?
হ্যাঁ। শুমান্তি মাথা নাড়ল, আজ হোক কাল যোক আমরা তো সবাই মারা যাব।
ইরন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ত্রানুস তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, আসলে আমরা একটু অন্যভাবে চিন্তা করি। আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয় বলে আমরা মারা যেতে একটুও দ্বিধা করি না। যে কারণে মারা যাচ্ছি সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হলে নিজের ভিতরে এক ধরনের আনন্দ পাই।
ইরন দীর্ঘ সময় ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, তোমরা বলতে চাইছ নিশিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে মারা যেতে তোমাদের কোনো ভয় নেই?