এই মহাকাশযানে এখন কেউ আর কিছু বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখ আমি তোমাদের পরিচিত কীশা নই। আমি একটি রোবট। ইরন যেটা সন্দেহ করেছিল, সেটা সত্যি।
ও।
যাও।
ত্রাস এবং শুমান্তি ছুটতে ছুটতে চলে গেল। ইরন হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে রেখে বলল, এখন কী হবে কীশা?
তোমরা দেখতে পাবে।
দেখতে পাব?
হ্যাঁ। আমি–আমি এই গ্ৰহটাতে যাব।
ইরন চমকে উঠল, এই গ্ৰহটাতে যাবে?
হ্যাঁ।
তুমি কেন এই গ্ৰহটাতে যাবে?
কারণ সেখানে নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমান প্রাণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?
হ্যাঁ।
কেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?
কারণ তাদের জন্য আমার একটি জিনিস নিয়ে যাবার কথা।
কী জিনিস?
সেটা এখন আর্কাইভ ঘরে আছে।
কী আছে আর্কাইত ঘরে?
কীশা কাতর গলায় বলল, আমাকে তুমি সেটা জিজ্ঞেস কোরো না। দোহাই তোমার। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার খুব কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়।
ঠিক আছে জিজ্ঞেস করব না।
ত্রাস এবং শুমান্তি দুই হাতে টেনে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসে ইরনের ঘরে ঢুকল। ভিতর থেকে টেনে যন্ত্রপাতি বের করে তারা ইরনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। মেডিক্যাল কিটের মনিটরে আঘাতের বর্ণনা বের হয়ে এসেছে। এমন কিছু গুরুতর আঘাত নয়, দ্রুত সেরে উঠবে।
ইরন জানত সে দ্রুত সেরে উঠবে। তাকে ওরা হত্যা করবে না। কিছুতেই হত্যা করবে না। ত্রালুস এবং শুমান্তিকে নিয়ে সে নিশ্চিত নয়, কিন্তু তাকে ওরা এত সহজে হত্যা করবে না।
২.৩ ছোট করিডোর ধরে ওরা চার জন
ছোট করিডোর ধরে ওরা চার জন আর্কাইভ ঘরটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের একেবারে অন্য মাথায় একটা ছোট এলিভেটরে করে ওরা উপরে উঠে এল। সরু আরেকটা করিডোর ধরে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ওরা আর্কাইভ ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ায়। সুইচ স্পর্শ করে দরজা খুলতে গিয়ে শুমান্তি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
ইরন জিজ্ঞেস করল, কী হল শুমান্তি?
শুমান্তি ইরনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভিতরে কী একটা শব্দ শুনেছি।
ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, সত্যি ভিতরে একটা শব্দ হচ্ছে। টুক টুক করে এক ধরনের শব্দ।
কীশা কঠিন গলায় বলল, দরজা খোল শুমান্তি।
শুমান্তি দরজা খুলল, এবং সাথে সাথে ভিতরে কী একটা যেন ঘরের এক পাশ থেকে ছুটে অন্য পাশে সরে গেল। শুমান্তি চমকে ওঠে, কে?
আর্কাইভ ঘরে নানা আকারের বাক্স এবং যন্ত্রপাতি ছড়ানো–ছিটানো রয়েছে। ঘরের মাঝামাঝি একটা চতুষ্কোণ বাক্স খোলা এবং তার ভিতরে একটা খোলা ক্যাপসুল। আকার দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি একজন মানুষের জন্য তৈরি। মানুষটি এই ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে সে এখানে লুকিয়ে আছে। ইরন একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেল–সে মনে মনে আশা করছিল কীশা যে জিনিসটি নিনীষ স্কেলের পঞ্চম মাত্রার প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাবে সেটি আর যা–ই হোক, কোন মানুষ যেন না হয়।
কীশা আলগোছে অস্ত্রটি ধরে রেখেছে, তার সামনে অন্য তিন জন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঠিক তখন আর্কাইভ ঘরের এক কোনায় একটি মাথা উঁকি দিল। কমবয়সী কিশোরী একটি মেয়ে, কুচকুচে কালো রেশমি চুল, কালো বড় ভীত চোখ। কেউ কোনো কথা না বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, এই ফুটফুটে কিশোরী মেয়েটিকে একটি গ্রহে ভিন্ন এক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া হবে?
মেয়েটি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন এসেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না, সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কী হল? তোমরা কথা বলছ না কেন?
কীশা এবারে এক পা এগিয়ে যায়, নিশি, তুমি জান আমরা কে। তুমি জান তুমি এখানে কেন এসেছ।
মেয়েটি এবারে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমি আসতে চাই নি। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।
কীশা আরো এক পা এগিয়ে গেল, না নিশি, তোমাকে জোর করে পাঠায় নি, তুমি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছ।
না! মেয়েটি ভয় পেয়ে একটি আর্তচিৎকার করে উঠল, না। আমি ইচ্ছে করে আসি নি। আমি বুঝতে পারি নি।
তুমি তো বাচ্চা মেয়ে নও যে তুমি বোঝ নি। তোমাকে সবকিছু বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের একটা বিশাল পরীক্ষায় তুমি রাজি হয়েছ। তোমার দরিদ্র বাবা–মাকে অনেক সম্পদ দেওয়া হয়েছে। তারা পৃথিবীতে এখন সুখী মানুষ। তোমার ছোট একটা আত্মত্যাগের জন্য
আমি আত্মত্যাগ করতে চাই না। আমি আমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে চাই! মেয়েটি হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।
নিশি তুমি তো এখন আর তোমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে পারবে না। তোমাকে এখানে পাঠানোর জন্য পৃথিবীর সকল সম্পদ একত্র করে এই মহাকাশ অভিযানটি শুরু হয়েছে। আমরা এখন সৃষ্টি জগতের অন্যপাশে। পৃথিবীর সময়ের সাথে এখানকার সময়ের কোনো মিল নেই।
মেয়েটি আর্কাইভ ঘরের আরো কোনায় সরে যেতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি তবুও পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই। আমি এখানে থেকে যেতে চাই না।
নিশি! তুমি কী বলছ এসব? কীশার গলার স্বর হঠাৎ কঠোর হয়ে ওঠে। তুমি জিনেটিক পরিমাপে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার চেহারা তোমার শরীর যেরকম নিখুঁত তোমার মস্তিষ্ক তোমার বুদ্ধিমত্তাও সেরকম নিখুঁত। আমি তোমার কাছে এ রকম ব্যবহার আশা করি না।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ হতে চাই নি। আমি সাধারণ একজন মানুষ হতে চাই–সাধারণ, খুব সাধারণ।