কীশা কোনো কথা না বলে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে কীশার কাছে এগিয়ে যায়, তুমি কী করছ?
কীশা একটু ইতস্তত করে বলল, আমি মহাকাশের চারপাশে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়২৫ তরঙ্গ মাপছি।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কেন?
কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় কি না দেখছি।
অস্বাভাবিক কিছু?
হ্যাঁ।
ইরন কীশার সামনে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো দেখল, এগুলো দৈনন্দিন ব্যবহারের যন্ত্র নয়, মহাকাশযানের প্রস্তুতির সময়েও তাদেরকে এগুলো দেখানো হয় নি। কীশা এগুলো খুঁজে পেল কেমন করে? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সে থেমে গেল। খানিকক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিক কী ধরনের অস্বাভাবিক সিগন্যাল খুঁজছ?
একটা বিশেষ কম্পন বা একাধিক বিশেষ কম্পন।
যদি খুঁজে পাও তা হলে কী হবে?
যদি খুঁজে পাই তার অর্থ আশপাশে কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে।
ইরন চমকে উঠে কীশার দিকে তাকাল, বুদ্ধিমান প্রাণী?
হ্যাঁ। পৃথিবী থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী এভাবেই খোজা হয়েছিল, মহাকাশের কোনো বিশেষ অংশ থেকে বিশেষ কোনো কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে কি না সেটা দেখা হয়। —
ও! ইরন কিছুক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কোনো বিশেষ সিগন্যাল পেয়েছ?
কীশা একটু হেসে বলল, না।
ইরন সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটি বিশেষ আলোকিত বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, এটা কী?
এটা কিছু নয়। কীশা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, এটা ক্যালিব্রেশান সিগন্যাল।
ইরন আবার হেঁটে হেঁটে মহাকাশযানের খোলা অংশের দিকে যেতে থাকে, ঠিক কী কারণ সে জানে না কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে তার ভিতরে অস্বস্তি বাধছে, কিন্তু ব্যাপারটি কী সে বুঝতে পারছে না। খোলা ডকে একটা কালো আসনে সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, পাশের সুইচ স্পর্শ করতেই একটা ছোট পোর্ট হোল খুলে গিয়ে সেখানে কালো মহাকাশ ফুঠে ওটে। পোর্ট হোলের ঠিক মাঝখানে স্পাইরাল গ্যালাক্সিটিকে দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে বেশ কষ্ট করে খালি চোখে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে দেখা যায়। কিন্তু এখান থেকে এই গ্যালাক্সিটিকে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঝখানে নক্ষত্রপুঞ্জের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলো, দুটি প্যাচানো অংশে লক্ষ কোটি নক্ষত্রের আলোক বিন্দু। দেখে মনে হয় সে বুঝি কোনো একটি টেলিস্কোপে চোখ রেখে বসে আছে। স্পাইরাল গ্যালাক্সিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইরনের চোখে ঘুম নেমে আসে। সে চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে বিচিত্র স্বপ্ন দেখে, অজানা একটি গ্রহে যেন সে হারিয়ে গেছে। গ্রহের লালচে মাটিতে সে হাঁটছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না, তার পা মাটিতে বসে যাচ্ছে। সে শুনতে পাচ্ছে দূরে কোথায় যেন একটি শিশু কাঁদছে, শিশুটির কাছে সে যেতে চাইছে কিন্তু যেতে পারছে না। যত তাড়াতাড়ি সে হাঁটতে চাইছে ততই যেন তার পা মাটিতে আরো শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে। মাটিতে শুয়ে সে শক্ত লাল পাথরে খামচে খামচে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু যেতে পারছে না। ধারালো পাথরের আঘাতে তার হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে ওঠে এবং সাথে সাথে তার ঘুম ভেঙে গেল।
ইরন ধড়মড় করে উঠে বসল। মহাকাশযানের আবছা অন্ধকারে পুরোপুরি জেগে উঠতে তার আরো কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটি ধধ করে শব্দ করছে। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে পোর্ট হোলের দিকে তাকাল, বাইরে এখনো নিকষ কালো অন্ধকার। এখনো সেখানে জ্বলজ্বলে কিছু নক্ষত্র এবং সেই বিচিত্র আলোকোজ্জ্বল স্পাইরাল গ্যালাক্সি। গ্যালাক্সিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইরন হঠাৎ চমকে উঠল, এটি পোর্ট হোলের ঠিক মাঝখানে ছিল কিন্তু এখন সেটি মাঝখানে নেই, ডান পাশে একটু সরে গেছে।
এটি হতে পারে শুধুমাত্র একটি জিনিস ঘটে থাকলে, মহাকাশযানটি যদি তার গতিপথের দিক পরিবর্তন করে থাকে।
ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, মহাকাশযানটিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, হঠাৎ করে কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল? কীভাবে?
ইরন উঠে দাঁড়ায়, ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কী হচ্ছে তাকে বুঝতে হবে, সবচেয়ে আগে কীশাকে খুঁজে বের করতে হবে। যোগাযোগ মডিউলটি হাতে নিয়ে কীশাকে ডাকতে গিয়ে সে থেমে গেল। যোগাযোগ কেন্দ্রে কীশা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পরিমাপ করছিল, এখনো হয়তো সেখানেই আছে। ঘরটির সামনে গিয়ে ইরন থমকে দাঁড়ায়, বাইরের দরজাটি বন্ধ। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে সে ভিতরে তাকাল। বড় হলোগ্রাফিক মনিটরে বিশেষ আলোকিত বিন্দুটি ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে উঠছে। বিন্দুটিকে কীশা ক্যালিব্রেশান বলে দাবি করছে কিন্তু তা হলে তার বড় হওয়ার কথা নয়–সব সময় একই আকারের থাকার কথা। এটি ক্যালিব্রেশানের বিন্দু নয়, এটি সত্যিকারের সিগন্যাল।
ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে হলোগ্রাফ্রিক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিকে শুধুমাত্র একভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মহাকাশের এই অংশে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে, তাদের সিগন্যাল লক্ষ্য করে এই মহাকাশযানটি দিক পরিবর্তন করে এখন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।