হ্যাঁ, খুব সুন্দর জায়গা। ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, এখানে বসে বাইরে তাকাতে খুব ভালো লাগে।
শিল্ডিংয়ের কী অবস্থা কে জানে। বাড়াবাড়ি রেডিয়েশান হলে এখানে থেকো না।
ত্রালুস মাথা নাড়ল, বলল, না, থাকব না।
ইরন একটা চেয়ারে বসে উপরের দিকে তাকাল। নিকষ কালো অন্ধকারে নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করছে। মাঝামাঝি একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। দূরে দুটি নক্ষত্রপুঞ্জ। এই আকাশের একটি নক্ষত্রকেও তারা আগে কখনো দেখে নি। ইরন আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, বলল, তোমরা নিশ্চয়ই খুব অস্থির হয়ে আছ, নিশ্চয়ই খুব অশান্তিতে রয়েছ। আমি দুঃখিত যে এ রকম একটা অবস্থায় আছি অথচ কিছু করতে পারছি না।
ত্রালুস এবং শুমান্তি অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকাল। ত্ৰালুস একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু ইরন
কী?
আসলে আমরা কিন্তু একেবারেই অশান্তিতে নেই। আমরা খুব আনন্দের মাঝে আছি। আমাদের আসলে খুব ভালো লাগছে।
ভালো লাগছে?
হ্যাঁ। কী চমৎকার শান্ত একটা পরিবেশ। নিরিবিলি সুমসাম। তা ছাড়া
তা ছাড়া?
তা ছাড়া আমরা তো আসলে খুব অস্বাভাবিক একটা পরিবেশে বড় হয়েছিলাম, কখনো নিজেদের ক্লোন ছাড়া অন্য কাউকে দেখি নি। নিজেদের ক্লোন আসলে নিজের মতো–তাদের সাথে থাকা আসলে নিজের সাথে থাকার মতো। তাদের সাথে কথাও বলতে হত। না, কারুণ, আমরা জানতাম অন্যেরা কখন কী ভাবছে, কখন কী বলবে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। এই যে আমার শুমান্তির সাথে দেখা হল, তার সাথে কথা বলছি, এটা যে কী আনন্দের তোমাকে বোঝাতে পারব না। সে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটা মানুষ, তার ব্যক্তিত্ব ভিন্ন, সব ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত আছে, চিন্তা করতে পার?
ইরন একটু অবাক হয়ে ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল, সে কখনোই চিন্তা করে নি মানুষের একেবারে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার–ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব বা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারার ব্যাপারটি কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তোমরা বলছ যে তোমরা খুব ভালো আছ!
হ্যাঁ। শুমান্তি এবং ত্রালুস একসাথে মাথা নাড়ল, বলল, আমরা খুব ভালো আছি।
তোমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাও না?
ত্রালুস এবং শুমান্তির মুখে ভয়ের একটা ছায়া পড়ল। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে থাকে। তারপর শুমান্তি নিচু গলায় বলে, না, আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই না। এখানেই আমরা খুব ভালো আছি। পৃথিবীতে ফিরে গেলে আবার আমাদের ছোট একটা জায়গায় অন্য ক্লোনদের সাথে রাখবে। আমাদের নাম থাকবে না, পরিচয় থাকবে না। শুমাস্তি ভয়ার্ত মুখে মাথা নাড়তে থাকে।
ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করত না যে কোনো মানুষ পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া থেকে এই মহাকাশযানে জীবন কাটিয়ে দেওয়াকে বেশি আনন্দদায়ক মনে করে। নামপরিচয়হীনভাবে থাকার ব্যাপারটি সে জানে না। ক্লোন করা বেআইনি, যারা করেছে তারা বড় অপরাধ করেছে। কিন্তু একবার করা হয়ে গেলে তাকে নিশ্চয়ই মানুষের সম্মান দিতে হবে। ইরন চিন্তিত মুখে বলল, পৃথিবীতে আমরা ফিরে যেতে পারব কি না জানি না। যদি যেতেও পারি তা হলে সেটি পৃথিবীর সময়ে কবে যাব জানি না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এই মহাকাশযানের মাঝে তো কেউ সারা জীবন কাটাতে পারবে না।
কেন পারবে না? আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি এখানে সবকিছু রি–সাইকেল২৪ করা যায়। কৃত্রিম খাবার তৈরি করা যায়–
ইরন হেসে বলল, সারা জীবন কৃত্রিম খাবার খেয়ে কাটিয়ে দেবে? একটা মহাকাশযানে?
কেন, তাতে অসুবিধে কী?
ইরন মাথা নাড়ল, তুমি যদি নিজে অসুবিধেটা বুঝতে না পার তা হলে কেউ তোমাকে বোঝাতে পারবে না। তা হলে বুঝতে হবে আসলেই কোনো অসুবিধে নেই।
ইরন মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। মহাকাশযানের অনেক ঘুঁটিনাটি তথ্য সে জানতে পারে যেটা অন্য কোনোভাবে তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। যেমন সে জানত না মহাকাশযানে ব্যবহারের জন্য দেহের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে, যুদ্ধ করার জন্য প্রচুর অস্ত্র রয়েছে, বিনোদনের জন্য পৃথিবীর প্রাচীনতম সংগীতের সংগ্রহ রয়েছে এবং প্রার্থনা করার জন্য পৃথিবীর সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু তারা কোথায় আছে সেই তথ্যটি কোথাও নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই তাদের করার নেই।
ইরন তথ্যকেন্দ্র থেকে সরে এসে কীশাকে খুঁজে বের করল। সে মহাকাশযানের যোগাযোগ কেন্দ্রে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে। ইরনকে দেখে কীশা তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, কী খবর ইরন?
কোনো খবর নেই। আমার ধারণা অদূর ভবিষ্যতেও কোনো খবর থাকবে না। আমরা হারিয়ে গেছি।
হারিয়ে গেছি?
হ্যাঁ। মহাকাশযানকে যদি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তা হলে একটা কথা ছিল!
তা হলে কী করতে?
ঠিক যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিক দিয়ে ফিরে যেতাম। মহাকাশযানের লগে পুরো গতিপথ রাখা আছে, ফিরে যাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। কিন্তু মহাকাশযানের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।