শুমান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি বিদায় নেব না, আমি সবার জন্য শুভ কামনা করছি।
কীশা কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ শুমান্তি।
এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি দুলে উঠল। মহাকাশযানের আলো নিভে গিয়ে নিভুনিভু হয়ে জ্বলতে থাকে। কর্কশ এলার্মের শব্দ মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়।
ইরন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পদার্থ–প্রতিপদার্থের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে অচিন্তনীয় ভরকে কেন্দ্রীভূত করে স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ছিন্ন ক্ষেত্রের অন্যপাশে এক বিচিত্র জগৎ অপেক্ষা করছে। ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন স্থান। হয়তো দূর কোনো গ্যালাক্সি, অন্য কোনো নক্ষত্র, কোনো ব্ল্যাকহোল বা কোয়াজারের কাছাকাছি। কোনো অজানা গহ, অজানা জগৎ। সেই দূর জগতে ভিন্ন এক সময়ে তারা পৌঁছাবে কয়েক মুহূর্তে। ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
চারপাশের দৃশ্য দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বৃহস্পতি গ্রহটি যেন চোখের সামনে গলে তরল পদার্থের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের গ্রহ নক্ষত্র গ্রহাণুপুঞ্জ যেন বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে ধীরে ধীরে নিকষ কালো একটি অন্ধকার গহ্বর বের হয়ে এল। সেই গহ্বরের মাঝে তাদের মহাকাশযান ছুটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল, মহাকাশযানের আলো নিভে গেল। ইঞ্জিনের গর্জন, এলার্মের তীব্র শব্দ সবকিছু থেমে গেল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ধদ্ধ করছে। ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, বুকের শব্দও ধীরে ধীরে থেমে আসছে। আলো নেই, অন্ধকার নেই, শব্দ নেই, নৈঃশব্দ্য নেই, বিচিত্র বোধশক্তিহীন এক জগতে সে ডুবে যাচ্ছে। পুরো মহাকাশযানটি অদৃশ্য এক জগতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইরন নিজের সমস্ত চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু বুঝতে পারে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।
এটাই কি মৃত্যু? নাকি এটা নতুন জীবন?
১.৬ পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে বিশাল স্ক্রিনে মহাকাশযানটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটি কাঁপা গলায় বলল, ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করেছে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি বলল, কী মনে হয় তোমার প্রজেক্টটি কি সফল হবে?
আমরা এক্ষুনি সেটি দেখতে পারব! যদি সফল হয় তা হলে তারা এক্ষুনি বের হয়ে আসবে। তাদের হিসাবে যত সময়ই লাগুক আমাদের হিসাবে সেটা হবে কয়েক মুহূর্ত।
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মানুষগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
২.১ মহাকাশযানটি আশ্চর্য রকম নীরব
মহাকাশযানটি আশ্চর্য রকম নীরব। গতিবেগ বাড়ানোর বা কমানোর সময় তার শক্তিশালী ইঞ্জিনটি চালু করা হয় তখন তার চাপা গুমগুম শব্দ অনুভব করা যায়। এখন এটি একটি বোয়াইট ডোয়ার্ফ২২ ধরনের সাধারণ নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ইঞ্জিনগুলো চালু করে রাখা নেই বলে কিছু বোঝার উপায় নেই। মহাকাশযানের গোলাকার জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকালে অপরিচিত নক্ষত্রগুলো চোখে পড়ে, সেগুলো দেখে মহাবিশ্বের কোথায় তারা চলে এসেছে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই।
মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে বলে পুরো মহাকাশযানে এক ধরনের কোমল আলো এবং অন্ধকার। মহাকাশযানের তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো নেই বলে এখানে এক ধরনের শান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ইরন মহাকাশযানের গোল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকার মহাকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মহাকাশযানের এই শান্ত পরিবেশটুকু আসলে তাদের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন নয়। তারা ভিতরে ভিতরে অশান্ত এবং অস্থির। কোথায় আছে এবং কোথায় যাচ্ছে জানে না বলে কিছুতেই স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না, ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছে না। মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার গত কয়েকদিন থেকে হিসাব করে যাচ্ছে, মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে রাখা মহাকাশের গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের তালিকার সাথে চারপাশের নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে বের করার চেষ্টা করছে তারা এখন কোথায়। কিন্তু এখনো কোনো লাভ হয় নি।
ইরন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মহাকাশযানের ডকিং বে৩ এর দিকে হাঁটতে থাকে। জায়গাটা মহাকাশযানের বাইরের দিকে, সেখানে বিশাল গোলাকার স্বচ্ছ ছাদের ভিতর দিয়ে বাইরে দেখা যায়, বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় তারা কত ক্ষুদ্র ব্যাপারটি হঠাৎ করে নতুনভাবে যেন তারা অনুভব করতে পারে।
ইরন মহাকাশযানের মূল লিফটে করে উপরের দিকে যেতে থাকে। বড় একটা করিডোর ধরে হেঁটে দ্বিতীয় একটি লিফটে করে ডকিং বেতে হাজির হল। গোলাকার ঘরটির মাঝামাঝি জায়গায় বসার জন্য আরামদায়ক কিছু চেয়ার সাজানো রয়েছে। তার একটিতে ত্রালুস এবং শুমান্তি পাশাপাশি অন্তরঙ্গভাবে বসে আছে। ইরনকে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে। তার দিকে তাকাল। এই ডকিং বেতে সে আগে কখনো আসে নি। ইরন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমরা এখানে? সময় কাটানোর জন্য ভালো একটা জায়গা পেয়েছ মনে হচ্ছে।