তুমি সেটা করতে পার?
ইরন হেসে ফেলল, বলল, না পারি না। তবে আমি এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। পৃথিবীতে একবার একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে গিয়ে প্রায় আধখানা শহর ধ্বংস করে ফেলেছিলাম।
কীশা সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি এখন আবার চেষ্টা করে দেখ। এখানে ধ্বংস করার কিছু নেই। আমাদের মহাকাশযানে প্রচুর এন্টি ম্যাটার আছে, স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে
হয়তো প্রচণ্ড চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারবে।
ইরন সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি তাই মনে কর?
চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। আমরা তো এমনিতেই মারা যাব।
যদি সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোল দিয়ে বের হয়ে অন্য কোনো জগতে চলে যাই?
সেটা তো আর এর থেকে খারাপ হবে না।
ইরন কীশার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাই ধারণা?
হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা।
.
ইরন কাজে লেগে গেল। পৃথিবীর একটি সম্ভ্রান্ত ল্যাবরেটরিতে যে কাজটি করার কথা, মহাকাশযানের সীমিত সুযোগ–সুবিধার মাঝে সেই কাজটি মোটামুটি অসম্ভব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি তত কঠিন নয়। মহাকাশযানটি যে প্রচণ্ড বেগে বৃহস্পতির দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় সঠিক বেগ হিসাবে বের হয়ে এল। এন্টি ম্যাটারকে সামনে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত হিসাবে দুটি শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন পাওয়া গেল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য এন্টি ম্যাটারের সমান পরিমাণ ভরকে প্রস্তুত। করা হল। এখন বাকি রয়েছে হিসাব করে বের করা কখন ঠিক কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো এবং ওয়ার্মহোলের মুখটি খোলার পর তার ভিতরে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে এই ধরনের হিসাবে বিশেষ পারদর্শী পাওয়া গেল। শুমান্তি প্রচলিত শিক্ষা পায় নি, কিন্তু এই মেয়েটি অসাধারণ বিজ্ঞানমনস্ক এবং কিছু জিনিস বুঝিয়ে দেবার পর সে প্রয়োজনীয় হিসাব করার কাজটি খুব সুচারুভাবে করতে শুরু করল। ত্রালুস এবং কীশা এন্টি ম্যাটারকে গতিপথের নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর জন্য রকেট ইঞ্জিন দুটিকে প্রস্তুত করতে শুরু করল।
পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে ইরন বৃহস্পতির পৃষ্ঠদেশে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে। তার ভিতর দিয়ে অন্য কোনো একটি জগতে পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। মহাকাশযানের কম্পিউটারের হিসাব অনুযায়ী সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক শূন্য তিন। যদি কিছু না করার চেষ্টা করে তা হলে বৃহস্পতির বায়বীয় পৃষ্ঠে ডুবে ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় এক শ ভাগ, কাজেই এই চেষ্টাটুকু করে দেখতেই হবে।
প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ করে চার জন নিজেদের ক্যাপসুলে আশ্রয় নেয়। সত্যি সত্যি যদি একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারে তা হলে মহাকাশযানটিকে যে গতিতে তার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে সেটি অচিন্তনীয়, এর আগে কেউ কখনো ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করে নি, ভিতরে কী ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। ছোটখাটো বাধার সম্মুখীন হলেই তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
ইরন সুইচ অন করে অন্য তিন জনের সাথে যোগাযোগ করল। কীশা পাথরের মতো মুখ করে অপেক্ষা করছে। ইরন জিজ্ঞেস করল, তোমার কি ভয় করছে?
হ্যাঁ।
চমৎকার–কারণ আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা খুব ভয়ের ব্যাপার। ভয় পাওয়ারই কথা।
কীশা কোনো কথা বলল না। ইরন আবার বলল, আমরা যে ক্যাপসুলের মাঝে আছি সেটি অত্যন্ত নিরাপদ, অনেকটা মাতৃগর্ভে থাকার মতো। কাজেই তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পার।
আমি ঘুমাতে চাই না।
বেশ। যেরকম তোমার ইচ্ছা। আমরা যখন ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করব তখন কী দেখব আমি জানি না। স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ওলটপালট হয়ে যাবে, আশা করছি এই মহাকাশযানটি এক জায়গায় থাকবে, এর একেকটি অংশ যেন একেক শতাব্দীতে একেক। গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে না পড়ে।
সেরকম হতে পারে?
ইরন হেসে ফেলল, বলল, নিশ্চয়ই হতে পারে। বিস্ফোরণের প্রচও ঝাঁপটায় আমরা ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারি। তোমরা তো শুনেছ সাফল্যের সম্ভাবনা মাত্র দশমিক শূন্য তিন!
ক্যাপসুলের ভিতরে মনোযোগ আকর্ষণ করে বিপ ধরনের একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে একটি যান্ত্রিক গলা শোনা গেল, মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের সতর্ক করা যাচ্ছে। আর ষাট সেকেন্ড পর এই মহাকাশযানটি একটি বিস্ফোরণের সম্মুখীন হবে।
ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, মহাকাশযান থেকে এন্টি ম্যাটার নিয়ে রকেট দুটি রওনা দিয়েছে। মহাকাশযানের ভর কেন্দ্রের পরিবর্তন হওয়াতে পুরো মহাকাশযানটি ভয়ানকভাবে দুলে উঠল। ক্যাপসুলের বাইরে থাকলে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। সে ক্যাপসুলের ভিতরে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকায়। ভয়ঙ্করদর্শন উজ্জ্বল লাল রঙে সময় দেখানো হচ্ছে, এক মিনিট খুব বেশি সময় নয় কিন্তু সেই সময়টাকে হঠাৎ খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
ইরন শান্ত গলায় বলল, কীশা, ত্ৰালুস এবং শুমান্তি, আমরা সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব কি না জানি না, যদি না পারি তোমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছি। যদি এই মুহূর্তটিই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়ে থাকে তা হলে সেই মুহূর্তটিকে অর্থবহ করার জন্য তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ত্রালুস নিচু গলায় বলল, আমি এত সুন্দর করে বলতে পারব না কিন্তু একই জিনিস বলতে চাই। তোমাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ।