প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তারা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল। মহাকাশযানের যারাই এই বাক্সগুলো রেখেছে তারা চায় না এগুলো ভোলা হোক। এর মাঝে রহস্যটুকু যেন আড়াল থাকে সেটাই তাদের উদ্দেশ্য। মহাকাশযানটি এর মাঝে বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ বলের আওতার মাঝে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে তার গতিবেগ বাড়ছে এবং সবাই সেটা বুঝতে পারছে। বিশাল মহাকাশযানটি বৃহস্পতির প্রবল আকর্ষণে তার দিকে ছুটে চলছে, তাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই।
আর্কাইভ ঘরের বাক্সগুলো খুলতে না পেরে মহাকাশযানের চার জন আবার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে একত্রিত হয়েছে। ত্ৰালুস এবং শুমান্তি যে করেই হোক পুরো ব্যাপারটিকে বেশ সহজভাবে নিয়েছে। জন্মের পর থেকেই ক্লোন হিসেবে বড় করার সময় সম্পূর্ণ অকারণে মৃত্যুবরণ করার জন্য তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, কাজেই এই পরিবেশটুকু তাদের জন্য একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগামী কয়েক দিনের মাঝে যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটবে সে সময় তারা যেন সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় থেকে মহাকাশযানের সত্যিকার মানুষ দুজনকে সাহায্য করতে পারে এখন সেটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
কীশা এর মাঝে বেশ ভেঙে পড়েছে, তার চেহারায় উদভ্রান্ত মানুষের একটি ছাপ পড়েছে। ইরন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, কীশা! তুমি মনে হয় বেশি ভেঙে পড়েছ–তুমি সম্ভবত জান না মৃত্যু খুব খারাপ কিছু নয়।
মৃত্যু নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা নেই ইরন। কিন্তু তার আগে আমাদের কিছু করার নেই, পুরো সময়টা বসে বসে দেখব আমরা বৃহস্পতিতে আছাড় খেয়ে পড়ছি, আমি সেটা মানতে পারছি না।
তুমি কী করতে চাও?
কিছু একটা করতে চাই। কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাই।
আমাদের কোনোরকম চেষ্টা করার কিছু নেই। মহাকাশযানটির কক্ষপথ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন আমরা সরাসরি বৃহস্পতিতে গিয়ে আঘাত করি। ইরন স্ক্রিনের দিকে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ, বৃহস্পতি গ্রহ। মাঝখানের লাল অংশটুকু দেখে মনে হয় না যে একটা লাল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?
কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি দেখতে চাই না। একটা গ্রহ যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
ত্রালুস ইতস্তত করে বলল, কীশা, তোমাকে আমরা ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। ঘুমের মাঝেই এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না।
কীশা মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি ঘুমাতে চাই না। আমি শেষটুকু দেখতে চাই।
ইরন অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে থাকে, তাকে খুব চিন্তিত দেখায়, কিছু একটা জিনিস তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কিন্তু সে ঠিক ধরতে পারছে না।
দেখতে দেখতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, মহাকাশযানের গতিবেগ আরো বেড়ে গেছে, বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সূক্ষ্ম স্তরের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। মহাকাশযানের সুচালো অ্যান্টেনাগুলোতে এক ধরনের নীলাভ আলো দেখা যাচ্ছে–সম্ভবত আয়োনিত১৮ গ্যাসের কারণে। স্ক্রিনে বৃহস্পতি গ্রহটি আরো স্পষ্ট হয়েছে, তার উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবাহ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে গ্রহটিকে জীবন্ত একটি কুৎসিত প্রাণী বলে মনে হয়। এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সবাই গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গত চব্বিশ ঘণ্টা কীশা মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকভাবে পুনরায় নতুনভাবে চালু করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে আবার কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে। মহাকাশযানের চার জন এসে বসেছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট এবং সে অন্যমনস্কতাবে আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর শব্দ করছে। কীশা খানিকটা ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ইরন।
ইরন মাথা তুলে কীশার দিকে তাকাল, বল।
তুমি কী চিন্তা করছ?
সেরকম কিছু নয়।
কিছুক্ষণ আগে দেখলাম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কম্পিউটারে কিছু একটা হিসাব করছ।
হ্যাঁ।
কী হিসাব করছ?
সেরকম কিছু নয়।
আমাদের বলতে চাইছ না?
ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। কীশা একটু আহত স্বরে বলল, ইরন তুমি আমাদের মাঝে একমাত্র বিজ্ঞানী। আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচানোর যদি কোনো উপায় থাকে সেটা শুধু তুমিই ভেবে বের করতে পারবে।
কোনো উপায় নেই।
হয়তো সাধারণ হিসাবে নেই। কিন্তু কোনো অসাধারণ হিসাবে। কোনো বিচিত্র উপায়ে–যে উপায়ে সাফল্যের সম্ভাবনা খুব কম?
ইরন তীক্ষ্ণ চোখে কীশার দিকে তাকাল, বলল, তুমি কোন উপায়ের কথা বলছ?
আমি জানি না। কীশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অস্বাভাবিক কোনো উপায়।
যেমন?
যেমন একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাওয়া।
ওয়ার্মহোল? শুমান্তি মাথাটা একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?
ইরন নিচু গলায় বলল, দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান এবং সময়কে একটা ফুটো দিয়ে জুড়ে দেওয়া যায়। সেটাকে বলে ওয়ার্মহোল।
তার মানে হঠাৎ করে সামনের স্থানটুকুর মাঝে একটা ফুটো তৈরি করা যাবে এবং সেই ফুটো দিয়ে বের হয়ে আমরা অন্য একটি জায়গায় অন্য একটি সময়ে বের হয়ে আসব?
অনেকটা সেরকম?
সেই জায়গাটা কোথায়?
অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে, অন্য কোনো শতাব্দীতে।