ভয়ঙ্কর একটি চিৎকারের শব্দ শুনল ইরন, কিছু বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ছুটে গেল এবং উষ্ণ এক ধরনের চটচটে তরল ছিটকে এসে পড়ল তার মুখে। ইরন হঠাৎ করে অনুভব করল তার গলায় বর্গেনের হাত শিথিল হয়ে এসেছে। বুকভরে একবার নিশ্বাস নিতে চাইল ইরন কিন্তু কাশির দমকে সে নিশ্বাস নিতে পারলনা। দুই হাতে বুক চেপে ধরে অনেক কষ্টে একবার নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকাল, পিছনে কীশা, তার চোখে বিস্ময় এবং আতঙ্ক। ইরন কীশার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝের দিকে তাকায়। সেখানে বর্গেনের মাথাটি পড়ে আছে, গলার অংশবিশেষ ছিঁড়ে এসেছে, সেখান থেকে কিছু ছেঁড়া তার, সূক্ষ্ম ফাইবার আর টিউব বের হয়ে এসেছে। চটচটে হলুদ এক ধরনের তরল সেখান থেকে গলগল করে বের হয়ে আসছে।
কীশা হতচকিতভাবে হাতের টাইটানিয়ামের রডটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, হলুদ রক্ত! হলুদ
ইরন বর্গেনের মস্তকহীন দেহ এবং শিথিল হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে এসে বলল, রক্ত নয়। কপোট্রনকে শীতল করার তরল।
কপোট্রন?
হ্যাঁ।
তার মানে বর্গেন একটা রোবট?
হ্যাঁ।
কী আশ্চর্য! কীশা পা দিয়ে বর্গেনের মাথাটিকে সোজা করে দিয়ে বলল, আমাদেরকে বলেছিল এখানে কোনো রোবট নেই।
বর্গেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ কেঁপে ওঠে এবং মুখ হাঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করে।
ইরন মুখে একটা বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটিয়ে বলল, তুমি কিছু বলছ?
বর্গেনের মাথাটি বিচিত্র একটি শব্দ করে বলল, হা।
কী?
তোমাদের দিন শেষ। বর্পেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। হাসির সাথে সাথে ঠোঁটের কষ বেয়ে হলুদ রঙের চিটচিটে তরলটি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হতে থাকে। ইরন অনেক কষ্ট করে একটা লাথি দিয়ে মাথাটি দূরে ছুঁড়ে ফেলার ইচ্ছে দমন করে নিচু হয়ে বসল। হাত দিয়ে বর্গেনের চুলের মুঠি ধরে মাথাটি উপরে তুলে বলল, আমাদের দিন শেষ কেন বলছ?
বর্গেন বিচিত্র এক ধরনের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, একটু পরেই তোমরা বুঝবে।
বর্গেন।
বল।
তুমি আর কতক্ষণ এভাবে থাকবে?
বেশিক্ষণ নয়। কপোট্রন শীতল করার তরলটা বের হয়ে গেছে, কপোট্রনটা কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে।
তোমার কি দুঃখ হচ্ছে?
দুঃখ? আমার? বর্গেনের মাথাটি হঠাৎ আবার কেঁপে কেঁপে হাসতে শুরু করে, আমাদের দুঃখ হয় না। একটা দায়িত্ব দিয়েছিল। দায়িত্বটা ঠিকভাবে শেষ করেছি তাই খুব আনন্দ হচ্ছে।
কীশা অবাক হয়ে বলল, দায়িত্ব ঠিকভাবে শেষ করেছ?
হ্যাঁ।
সেটা কখন করলে?
এই যে তোমাদের একটা মহা গাড্ডার মাঝে এনে ফেলেছি। মহাকাশযানের কন্ট্রোল এখন কারো কাছে নেই। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হত আমাকে দিয়ে আমাকেও তোমরা শেষ করেছ। এখন তোমরা বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে সেখানে গিয়ে শেষ হবে! তোমরা বর্গেন কথা শেষ করার আগেই আবার খিকখিক করে অপ্রকৃতিস্থর মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ হেঁচকি দিয়ে সে থেমে গেল। বর্গেনের কান এবং চোখ দিয়ে কালো আঁজালো এক ধরনের ধোঁয়া বের হতে শুরু করে, ইরন তার হাতে উত্তাপ অনুভব করে বিচ্ছিন্ন মাথাটি মেঝেতে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শেষ। কপোট্রনটা জ্বলে গেছে।
রক্ষা হয়েছে। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ানক ব্যাপার!
ইরন কথা না বলে চিন্তিত মুখে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যায়। কীশা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমার কাছে এখনো পুরো ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, দুঃস্বপ্ন?
হ্যাঁ। আমার কাছে কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে একটা নাটক। আমরা সবাই সেই নাটকের একটা করে চরিত্র।
কেন? কীশা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কাছে এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
জানি না।
কীশা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন কী করব আমরা?
প্রথমে দেখব বর্গেনের শেষ কথাগুলো সত্য কি না। অর্থাৎ আসলেই আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃহস্পতির আকর্ষণে সেদিকে যাচ্ছি কি না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমি দেখেছি অশুভ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আশ্চর্যভাবে সবসময় মিলে যায়। সম্ভাবনার মূল্যবান সূত্রগুলো সেখানে আশ্চর্যভাবে দুর্বল!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
আমার মনে হয় ত্ৰালুস আর শুমান্তিকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া দরকার।
কেন?
কী করব সেটা ঠিক করা যাক। যত বেশি মানুষ বসে সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায় ততই ভালো।
১.৫ কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিল
কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, সে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছে। ত্রালুস এবং শুমান্তি শান্তমুখে ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কীশা একটা লম্বা বিশ্বাস ফেলে বলল, কিছু একটা বল ইরন।
ইরন মাথা তুলে তাকাল, বলল, বলব আমি?
হ্যাঁ।
বলার মতো কিছু আছে? আমাদের অবস্থা হচ্ছে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো। আমরা জানি আগুনে আমরা নিশ্চিতভাবে পুড়ে মরব কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।
কিন্তু এটা কি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়? একটা মহাকাশযান পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় বৃহস্পতি গ্রহের দিকে ছুটে যাচ্ছে?
না, মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারণ এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে। আমরা যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন বর্গেন উঠে এসে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণে বড় পরিবর্তন করেছে। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ মডিউলটি সরিয়ে দিয়েছে। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করেছে। কেন করেছে সেটা একটা রহস্য। আমাদেরকে মেরে ফেলাই যদি এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেটা কি পৃথিবীতে আরো সহজে করা যেত না?