বেশ! আমি এই অভিযানের একজন সদস্য। কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ হলে আমিও বের হতে পারি।
বর্গেন হঠাৎ পুরোপুরি ঘুরে ইরনের দিকে তাকাল, বলল, তোমার কী নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, ইরন?
যেমন মনে কর এই মহাকাশযানের ত্বরণ আর এই মহাকাশযানের গতিবেগ। যত হওয়ার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়। কেন?
তার কারণ আমরা এখন এস্টরয়েড বেন্ট পার হচ্ছি। এর মাঝে গতিবেগ বেশি করা যায় না। নিরাপত্তার ব্যাপার।
ইরন স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল–এক শ বছর আগে এই উত্তরটি যথার্থ উত্তর হত, এখন নয়। মহাকাশযান এস্টরয়েড বেল্টের১১ ভিতর দিয়ে যে কোনো বেগে যেতে পারার কথা। বর্গেন মিথ্যা কথা বলছে, কিন্তু কেন?
বর্গেন কন্ট্রোল প্যানেলের উপর আবার ঝুঁকে পড়ে বলল, ক্যাপসুলে ফিরে যাও ইরন।
আমি এখন ক্যাপসুলে ফিরে যাই কি না যাই তাতে কিছু আসে–যায় না।
বর্গেন আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল, তুমি কী বলতে চাইছ?
ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল বর্গেন, মহাকাশযানে অক্সিজেন খুব কম। আমাকে মুখে একটা মাস্ক লাগাতে হয়েছে। তোমার মুখে মাস্ক নেই কেন?
বর্গেন তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। ইরন আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, বর্গেন, এই মহাকাশযানে তোমার নিশ্বাস নিতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না, কারণ তোমার আসলে নিশ্বাস নিতে হয় না। তুমি একজন রোবট।
বর্গেনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ইরন বাধা দিয়ে বলল, বর্গেন, আমি রোবটকে দুই চোখে দেখতে পারি না। প্রজেক্ট আপসিলনে একটা রোবটকে পাঠানো হয়েছে জানলে আমি এখানে আসতাম না।
তোমার কথা শেষ হয়েছে ইরন?
আমি আসলে রোবটের সাথে কথাবার্তা বলতে চাই না বর্গেন। কাজেই আমার কথা শেষ হয়েছে কি না সেটা বলতে পারব যখন নিঃসন্দেহে হব যে তুমি সত্যিই একটা রোবট।
সেটা তুমি কীভাবে হবে, ইরন?
ইরন দেয়াল থেকে টাইটানিয়ামের একটা বড় রড টেনে খুলে নিয়ে বলল, এটা দিয়ে। একটা আঘাত করে তোমার খুলি ফাটিয়ে দিয়ে দেখব, ভিতরে কপোট্রন না অন্য কিছু।
বর্গেন এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি নেহায়েত একজন নির্বোধ মানুষ ইরন। আমি যদি সত্যিই রোবট হয়ে থাকি তা হলে আমার এই যান্ত্রিক হাত দিয়ে আমি তোমাকে পিষে ফেলতে পারব। তোমার মস্তিষ্ক আমি থেতলে দিতে পারব।
ইরন শক্ত হাতে টাইটানিয়ামের রডটা ধরে রেখে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে–যায় না। প্রজেক্ট আপসিলন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার কিছুই সত্যি নয়। আমাদের নিয়ে তোমরা কিছু একটা ষড়যন্ত্র করেছ। তোমাকে খুন করা গেলে কিংবা আমি খুন হয়ে গেলে সেই ষড়যন্ত্রটা কাজে লাগাতে হবে না। আপাতত সেটাই আমার উদ্দেশ্য।
ইরন হিংস্র চোখে বৰ্গেনের দিকে তাকিয়ে আরো এক পা এগিয়ে গেল। বর্গেন শীতল চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, নির্বুদ্ধিতা কোরো না, ইরন। আমি তোমাকে শেষবার সতর্ক করে দিচ্ছি
বর্গেন কথা শেষ করার আগেই ইরন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বর্গেন প্রস্তুত ছিল বলে। ইরন তাকে আঘাত করতে পারল না, বরং তার শক্ত হাতের আঘাতে সে নিজে ছিটকে গিয়ে পড়ল। কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সে এগিয়ে যায়, টাইটানিয়ামের রডটি ঘুরিয়ে আবার সে আঘাত করার চেষ্টা করে, কিন্তু বর্গেন বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে তার হাতে আঘাত করতেই টাইটানিয়ামের রডটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ইরন শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং বর্গেন শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক পা এগিয়ে আসে। ইরন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার বর্গেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বর্গেন তার শক্ত হাতে ইরনের মুখে আঘাত করল, মুহূর্তের জন্য ইরন চোখে অন্ধকার দেখে, তাল হারিয়ে সে দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ল। ইরন তার মুখে রক্তের লোনা স্বাদ পায়, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। বর্গেন তার দিকে এগিয়ে আসে, দুই হাত দিয়ে নিওপলিমারের১৩ তৈরি তার বুকের কাপড় ধরে তাকে উপরে টেনে তুলল, তার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলা করতে শুরু করেছে। শক্ত লোহার মতো দুই হাতে তার গলা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমি যদি বলতে পারতাম জীবনের শেষ মুহূর্তে তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে ইরন, তা হলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু আমার এতটুকু দুঃখ হচ্ছে না। তোমার কার্টিলেজ১৪ আমি এক হাতে ভাঙতে পারি নির্বোধ মানুষ–
ইরন বুঝতে পারে তার গলায় বর্গেনের হাত শক্ত সঁড়াশির মতো চেপে বসেছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। সমস্ত বুক বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে, দুই হাতে বর্গেনের চোখে–মুখে খামচে ধরার চেষ্টা করে, নখ বসিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পাথরের মতো শক্ত শরীরে তার হাত পিছলে আসে।
ইরনের চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ তার মাঝে সে কীশাকে দেখতে পেল। দুই হাতে টাইটানিয়ামের রডটি শক্ত করে ধরে রেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ইরন প্রাণপণ চেষ্টা করে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় বর্গেনের পিছন থেকে। ধীরে ধীরে কীশা টাইটানিয়ামের রডটি উদ্যত করেছে। তারপর কিছু বোঝার আগে কীশা প্রচণ্ড শক্তিতে বর্গেনের মাথায় আঘাত করল।