পুলিশ কর্মকর্তাকে এবারে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখায়, সে কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, কিন্তু বিনোদন কেন্দ্রটা একটু দেখে এলে তো কোনো ক্ষতি নেই। তারা তো যেতেও পারে। পারে না?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, যেতে পারে কিন্তু তার সম্ভাবনা খুবই কম। তারা অন্য কোথাও গেছে।
রন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, কিন্তু কোথায়?
কাঁদো কাঁদো গলায় একজন মা বলল, তার চেয়ে বড় কথা, কেন? কেন?
১৬.
রিকি নীলকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি শক্ত করে ধরেছ?
নীল গ্লাইডারের হালকা অ্যালুমিনিয়ামের টিউবটা শক্ত করে ধরে বলল, হ্যাঁ ধরেছি।
তোমার ভয় করছে না তো?
নীলের বুকের ভেতর ধক ধক শব্দ করছিল কিন্তু সে মুখে বলল, না। ভয় করছে না।
ঠিক আছে। আমি যখন বলব এক দুই তিন তখন দৌড়াতে শুরু করব। বুঝেছ?
বুঝেছি।
দশ পা দৌড়ে পা দিয়ে পাহাড়টাকে ধাক্কা দিয়ে লাফ দেব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
যখন ভাসতে থাকব তখন পাগুলো পিছনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ব। শরীরের ওজনটা সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বুঝেছ?
বুঝেছি।
সমানভাবে না ছড়ালে গ্লাইডারটা গোত্তা খেয়ে পড়তে থাকবে।
নীল বলল, আমি শুয়ে ওজনটা সমানভাবে ছড়িয়ে দেব।
ঠিক আছে তা হলে আমরা শুরু করি। রিকি বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এক দুই তিন_ তারপর দৌড়াতে শুরু করল। গুনে গুনে দশ পা দৌড়ে দুজনে একসাথে পাহাড়টাকে ধাক্কা দিয়ে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাথে সাথে গ্লাইডারটা আকাশে ভেসে যায়!
রিকি খুশিতে চিৎকার করে বলল, চমৎকার!
নীল রিকির দেখাদেখি সাবধানে নিজের শরীরটা ভেতরে টেনে এনে ক্যানভাসের টুকরোটার ওপর শুয়ে পড়ে। গ্লাইডারটা ধীরগতিতে ভেসে যেতে থাকে, নীল দেখতে পায় নিচে অন্যেরা দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। কয়েক মিনিট যাবার পর নীল যখন বুঝতে পারল হঠাৎ করে তারা পড়ে যাবে না-ডানা ছড়িয়ে থাকা একটা পাখির মতোই তারা শান্ত ভঙ্গিতে আকাশে উড়ে যাবে, তখন নীল বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে বলল, কী আশ্চর্য!
কী হয়েছে?
আমরা কী বোকা।
কেন তোমরা বোকা কেন?
নীল গ্লাইডারের পিছনের রাডারকে একটু টেনে ডান দিকে ঘুরিয়ে বলল, আমরা একটা ঘরের ভেতরে বসে কম্পিউটারে ফ্লাইট সিমুলেশন খেলতাম–আকাশে উড়ার একটা কম্পিউটারের খেলা! আর তুমি সত্যি সত্যি আকাশে উড়ো!
এখন তো তুমিও উড়ছ।
হ্যাঁ। আমিও উড়ছি। নীল হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল।
রিকি জিজ্ঞেস করল, কী হল? হাসছ কেন?
আমাদের প্রিন্সিপাল কেটি এখন কী করছে চিন্তা করে হাসছি!
কী করছে?
জানি না। আমরা যেন সব সময় নিরাপদে থাকি, কোনোভাবে যেন আমাদের কোনো বিপদ না হয় সেটার চিন্তা করতে করতেই সে অস্থির হয়ে থাকে। এখন যদি দেখত আমি গ্লাইডারে করে আকাশে উড়ছি তার নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই মাথা উঁচিয়ে গ্লাইডারে করে ভেসে যাওয়া রিকি আর নীলের দিকে তাকিয়ে রইল। কিয়ার ঘাড়ে বসে একটা ছোট বানরের বাচ্চা খুব মনোযোগ দিয়ে এক টুকরো রুটি কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বানরের বাচ্চাটার। সাথে ভাব করে সে তাকে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে নিতে পেরেছে। সে বানরের বাচ্চাটির মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই যে বানর বাহাদুর। তুমি কি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে? দেখো আমি তোমাকে কত আদর করব!
বানরের বাচ্চাটি দাঁত বের করে মুখভঙ্গি করে এক ধরনের শব্দ করল। কিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, দেখেছ? দেখেছ? আমার সাথে যেতে রাজি হয়েছে!
মাতিষা হিহি করে হেসে বলল, কচু রাজি হয়েছে। সে মুখ খিঁচিয়ে বলেছে, কখনো যাব না!
কিয়াও এবারে হিহি করে হাসতে থাকে, বলে, খা! মনে হয় সেটাই হয়েছে! বানরের বাচ্চাটা বলছে আমাকে কি মানুষের বাচ্চার মতো বোকা পেয়েছ যে তুমি বলবে আর আমি চলে যাব?
লন অনেকক্ষণ থেকে তার কনুইয়ের কাছে চুলকাচ্ছিল, জায়গাটা লাল হয়ে উঠেছে। লাল চুলের একটা মেয়ে বলল, এখনো চুলকাচ্ছে।
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
মাতিষা মুখ শক্ত করে বলল, তোমার একটা উচিত শিক্ষা হয়েছে! রিকি এত করে বলল এই গাছটার কাছে যেও না। পাতাগুলো বিষাক্ত–তুমি বিশ্বাস করলে না! বাহাদুরি করতে এগিয়ে গেলে।
লন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল আমি ভেবেছিলাম রিকি ঠাট্টা করছে! গাছের পাতা আবার বিষাক্ত হয় কেমন করে? এমন সুন্দর কচি সবুজ পাতা!
এখন বুঝেছ তো?
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ বুঝেছি।
ঠিক এরকম সময় গাছের শুকনো পাতায় সরসর করে একটা শব্দ হল, সবাই মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে একটা মোটা সাপ হেলে-দুলে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরপর মুখের ভেতর থেকে জিব বের করে চারপাশের অবস্থাটা একটু পরীক্ষা করে দেখছে।
ছোট ছোট চুলের ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল, দেখেছ? দেখেছ সাপটা কী সুন্দর?
হ্যাঁ। কী সুন্দর গায়ের রঙ। আর কী স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী।
মনে হচ্ছে হাত দিয়ে টিপে দেখি!
কিয়া মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। রিকি বলেছে বনের কোনো প্রাণীকে বিরক্ত করতে হয় না। তাদের শুধু দেখতে হয়।
মাতিষা কিছু বলল না, কয়দিন আগে হলেও সে সাপ দেখলে ভয়ে চিৎকার করত। মাকড়সা দেখলে ঘেন্নায় সিটিয়ে যেত! কিছুক্ষণ রিকির সাথে থেকেই সে জেনে গেছে আসলে এই পৃথিবীটা সবার জন্যে! এখানে মানুষও থাকবে পশুপাখিও থাকবে পোকামাকড়ও থাকবে। কেউ কাউকে ভয় পাবে না কেউ কাউকে ঘেন্না করবে না!