- বইয়ের নামঃ পরেশের হইলদা বড়ি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
পরেশ বৈদ্য
পরেশ বৈদ্য নয়াবাজারে একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করে। বত্রিশ ভাজা কাজ। সকালে দোকান ঝাড় দিয়ে তার দিনের শুরু হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত খদ্দেরদের সে কাপড় দেখায়, বিকিকিনি করে। ক্যাশ দেখে দুপুরে তার এক ঘণ্টার ছুটি। এই এক ঘণ্টায় সে রান্নাবান্না করে। তার রান্নার হাত ভাল। দোকানের মালিক আজিজ মিয়া তার হাতের রান্নার বিশেষ ভক্ত। অনেককেই তিনি বলেছেন, হিন্দুটা রান্ধে ভাল। বিশেষ করে মাষকলাইয়ের ডাল। বাংলাদেশে এত ভাল মাষকলাইয়ের ডাল আর কেউ যদি রানতে পারে তাহলে আমি কান কেটে ফেলব।
আজিজ মিয়া পরেশ বৈদ্যকে খুবই পছন্দ করেন। মানুষটা সৎ। তার কোন দাবি দাওয়া নাই। থাকা খাওয়া এবং মাসে মাত্র তিনশ টাকায় এমন বিশ্বাসী লোক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আজিজ মিয়া প্রায়ই ভাবেন পরেশের বেতন বাড়িয়ে পাঁচশ করে দেবেন। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। দোকানে হাটবার ছাড়া বিকিকিনি একেবারেই নাই। নয়াপাড়া অতি অজ জায়গা। অঞ্চলটাও দরিদ্র। গামছা ছাড়া কাপড় কেনার সামর্থ্যও মানুষের নেই।
বেতন বাড়াতে না পারলেও ভদ্র ব্যবহার দিয়ে আজিজ মিয়া সেটা পুষিয়ে দেন। দোকান বন্ধ করে বাড়িতে যাবার সময় তিনি পরেশকে সঙ্গে নিয়ে যান, বাড়িতে পাশে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়ান। খাওয়া দাওয়ার শেষে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করেন। পরেশ দোকানে ফিরে যায়। রাতে সে দোকানেই ঘুমায়।
আজিজ মিয়ার চার মেয়ে। বড় দুটা বিবাহযোগ্য। তাদের জন্যে পাত্র খোঁজা হচ্ছে। মন মত পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। পরেশ বৈদ্য হিন্দু না হয়ে মুসলমান হলে তিনি অবশ্যই তার বড় মেয়ে পরীবানু খানমের সঙ্গে তার বিবাহ দিতেন। পরেশ যদি এখন মুসলমান হয় তাহলে তিনি বিবেচনা করবেন। শুধু পরেশের বয়স একটু বেশি। চল্লিশের উপর। তবে পুরুষ মানুষের জন্য বয়স কিছু না। মেয়েদের বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরুষের না।
তিনি বিষয়টা নিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম হতভম্ব হয়ে বলেছেন, মালাউনের সাথে মেয়ে বিবাহ দিতে চান? কী বলেন আপনি?
মুসলমান হবার পরে বিবাহ করবে। ইসলাম ধর্মীয় মতে বিবাহ।
কচ্ছপ খাওইন্যার সাথে মেয়ের বিবাহ ছিঃ।
মুসলমান হবার পরে তো আর কচ্ছপ খাবে না।
এইসব আপনি ভুলে যান। কর্মচারীর সাথে মেয়ের বিবাহ! আল্লাহ মাফ করুক। ছেলের শিক্ষা নাই দীক্ষা নাই। আপনার মেয়ে কলেজে ভর্তি হইছে।
মানুষের কাজ শুধুই দেখে যাওয়া
পরেশ বৈদ্যের লেখাপড়ায় সামান্য ঘাটতি আছে। সে ক্লাস সিক্স সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। তবে তার হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর। মুক্তার মত অক্ষর। তবে মুক্তাক্ষর কোন পাত্রের গুণ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না।
এক আষাঢ় মাসের কথা। সারাদিন খটখটে রোদ গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ আকাশ কাল মেঘে ঢেকে গেল। শুরু হল প্রবল বর্ষণ। আজিজ মিয়া ঠিক করলেন আজ আর বাড়ি ফিরবেন না। দোকানেই রাতটা কাটিয়ে দেবেন। কাদা ভেঙে দুই মাইল হাঁটার অর্থ হয় না। তাছাড়া বাড়ির কাছাকাছি খালের মত আছে। আগে পায়ে হেঁটে খাল পার হওয়া যেত। গত কয়েকদিনে পানি বেড়েছে। আজ যে বৃষ্টি হচ্ছে খালে সাঁতার পানি হয়ে যাবার কথা।
আজিজ মিয়া পরেশকে ডেকে বললেন, ভাত বেঁধে ফেল। রাতে আর বাড়িতে যাব না।
পরেশ নিচু গলায় বলল, মামানি দুচিন্তা করবেন না? (আজিজ মিয়ার স্ত্রীকে পরেশ মামানি ডাকে) আজিজ মিয়া বললেন, কৰুক দুশ্চিন্তা। মেয়েছেলে যদি মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা না করে তাহলে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়। আল্লাহপাক মেয়েছেলে পয়দা করেছেন দুশ্চিন্তা করার জন্যে।
রাতে খাবেন কী?
মাংস খেতে মনে চাচ্ছে। মাংস এখন পাব কই। খিচুড়ি করো। সঙ্গে ডিম ভুনা। পাতলা খিচুড়ি করবে।
আচ্ছা করব।
খিচুড়ির মধ্যে চায়ের চামচের দুই চামচ যি দিয়ে দিও। ঘিয়ের সুঘ্ৰাণ ভাল লাগবে।
ঘি আছে না? আছে।
কাঁঠালের বিচি দিয়ে ঝাল মুরগির মাংস খেতে পারলে দিলখুস হত। ডিমও খারাপ না।
আজিজ মিয়া রাতে খুব তৃপ্তি করে খেলেন। তিনি ঠিক করলেন, বৃষ্টি বাদলার দিনে পরেশকে দিয়ে সব সময় পাতলা খিচুড়ি এবং ডিমের তরকারি করতে বলবেন। তার পান তামাকের অভ্যাস নেই। তারপরেও তিনি দুটা পান খেলেন। পরেশকে দিয়ে সিগারেট আনালেন। সিগারেট ধরিয়ে অতি আনন্দে টানতে লাগলেন।
দোকানের গদিতে বিছানা করা ছিল। তিনি ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় গেলেন। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে। ঝুম ঝুম শব্দ। আরামদায়ক ঠাণ্ডা হাওয়া। আজিজ মিয়ার মনে হল তিনি জগতের অতি সুখী মানুষদের একজন।
পরেশ বলল, মামা (আজিজ মিয়াকে সে মামা ডাকে) মাথা বানায়া দেই।
আজিজ মিয়া জড়ানো গলায় বললেন, লাগবে না লাগবে না। তুমি ঘুমাও।
পরেশ বলল, একটু চুল টেনে ঘুম পাড়ায়ে দেই। আরাম লাগবে।
পরেশ চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আজিজ মিয়ার এত আরাম লাগছে যে বলার না। আবার ঘুম পাচ্ছে প্রচণ্ড। তিনি চেষ্টা করছেন জেগে থাকতে। ঘুমিয়ে পড়লে এই আরামটা পাওয়া যাবে না।
পরেশ।
জ্বি মামা?
এ রকম মাথা বানানো কোথায় শিখেছ? একমাত্র নাপিতরাই এত সুন্দর মাথা বানায়। তোমাদের বংশে কোন নাপিত ছিল।
না মামা।
তোমার বেতন বাড়ানোর চেষ্টা নিব। বাড়ানো উচিত। রোজগার পাতি নাই। বলে কিছু করতে পারতেছি না।
দরকার নাই মামা।
দরকার যে নাই তুমিতো বলবেই। কারণ তুমি অতি ভাল ছেলে। তুমি যদি কচ্ছপ খাওয়া ধর্মের না হতে অবশ্যই পরীবানুর সঙ্গে তোমার বিবাহ দিতাম। পরীবানুর চেহারা ছবিতে খারাপ না। কী বলে? তবে মিজাজ ভাল না। মায়ের মত চড়া মিজাজ। মেয়েছেলের চড়া মিজাজ সংসারের জন্যে ভাল না।
পরেশ জবাব দিচ্ছে না। একমনে চুল টেনে যাচ্ছে। আজিজ মিয়া চিৎ হয়ে ওয়েছিলেন এবার পাশ ফিরলেন। পাশ ফিরে আরাম আরো বাড়ল। পরেশ এখন ঘাড় ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। এই ম্যাসেজে আরাম আরো বেশি হচ্ছে। আজিজ মিয়া চেষ্টা করছেন আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকতে। ঘুমিয়ে পড়া মানে সব শেষ।
পরেশ।
মামা বলেন।
চুপ করে থাকবা না। কথা বলে। গল্প গুজব করো।
কী গল্প করব?
যা ইচ্ছা করে। মাথা ম্যাসেজ ছাড়া আর কী বিদ্যা তুমি জানো? বলতে থাক শুনি। আমার ধারণা তুমি আরো অনেক কিছু জাননা।
জানি মামা।
বলো। একটা একটা করে বলে। বাদ্য বাজনা জানো?
না বাদ্য বাজনা জানি না। তবে আমি সামনে পিছনে সব দেখতে পারি।
এইটা কি বললা পরেশ। সামনে পিছনে তো সবেই দেখে। সামনে দেখি আবার ঘাড় ঘুরাইয়া পিছনে তাকাইলে পিছন দেখি।
আমারটা এই রকম না।
কীরকম?
ধরেন আইজ থাইক্যা এক লাখ বছর পরে পৃথিবীর কী অবস্থা এই গুলান দেখতে পারি।
ভাল খুব ভাল।
একজন আমারে একটা হইলদা বড়ি খাওয়াইছিল তখন থাইক্যা দেখি।
কী বড়ি।
হইলদা বড়ি।
আজিজ মিয়া পুরোপুরি তার মধ্যে চলে গেলেন। চেতনার অতি সামান্যই অবশিষ্ট আছে। পরেশের কথা শুনছেন পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। নিজেও মাঝে মধ্যে কথা বলছেন। কী বলছেন সেই বিষয়েও তাঁর ধারণা নেই।
পরেশ বলল, আমি সবই দেখতে পাই।
আজিজ মিয়া বললেন, সব দেখতে পাওয়াই ভাল। কিছু দেখা কিছু না দেখা ভাল না।
আসমানে যে চণ্ড আছে সেই চণ্ড কিন্তু মামা থাকবে না। পৃথিবীর উপরে আইসা পড়বে।
পড়ুক। ধুম কইরা পড়ুক। চণ্ড না থাকা ভাল। চণ্ড আসমানে থাকলেই জোছনা হয়। সেই জোছনায় অনেক পাপ কাৰ্য হয়। আমি নিজেই এই রকম একটা পাপ কাৰ্য করেছিলাম। পাট ক্ষেতে। আসমানে চণ্ড থাকা উচিত না। গেরামে পাটতে থাকাও উচিত না। বুঝেছ?
বুঝেছি মামা। সূর্যের কী গতি হইব শুনবেন?
বলো শুনি।
সূর্য সবকিছু টান দিয়া নিজের উপরে ফেলব। আগুনের থাবা বাইর কইরা টান দিব। তারপরে ছোট হওয়া ধরব। বিন্দুর মত ছোট হইব।
কি বললা–বিন্দু?
হুঁ মামা বিন্দু।
আমার খালাতো এক বোন ছিল বিন্দু নাম। বিবাহ হয়েছে জামাই সউদিতে কাজ করে বিরাট পয়সা করেছে।
জগতের যা কিছু আছে বুঝছেন মামা, সব একদিন আন্ধাইর হইয়া যাইব। আসমানে কোন তারা থাকব না। সব নিভা। তখন মাঝে মইদ্যে গমগম আওয়াজ উঠব। মামা বুঝছেন?
বজ্ৰপাতের আওয়াজ। বুঝেছি। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বজ্ৰ পড়বই। ঠাণ্ডা হাওয়া দিতেছে। গায়ে একটা চাদর দিয়া দেও।
পরেশ মামার গায়ে চাদর দিতে দিতে বলল, হইলদা বড়ি আমারে কে দিছিল সেই ঘটনা শুনবেন মামা? বিরাট ইন্টারেস্টের ঘটনা।
বড়ি পয়সা দিয়া খরিদ করছিলা?
না। এবেই দিছে।
বিরাট বড় হাই তুলতে তুলতে আজিজ মিয়া বললেন, মাগনা অষুধে কাম করে না। অষুধ বিষুদ যখনই কিনবা এক পয়সা হইলেও হাদিয়া দিবা। মনে থাকব?
থাকব। এখন কি ঘটনাটা বলব?
কী ঘটনা।
হইলদা বড়ি কে দিছে সেই ঘটনা। বিরাট ইন্টারেস্টের ঘটনা।
বাদ দেও। ঘটনা যত কম শুনা যায় ততই ভাল। ঘুমে চউখ বন্ধ হইয়া আসতেছে। এখন ঘুমাব।
আচ্ছা ঘুমান।
তুফান হইতেছে না কি?
না এখনো শুরু হয় নাই। তবে শেষ রাইতে বিরাট তুফান হইব। লণ্ডভণ্ড তুফান।
কে বলছে?
আপনেরে বলছি না হইলদা বড়ি খাওনের পরে আমি সব জানি। দূরের জিনিস যেমন জানি কাছের জিনিসও জানি।
ও আইচ্ছা। জানা ভাল। কাছের জিনিস জানা খারাপ না।
বলতে বলতে আজিজ মিয়া ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যে তাঁর নাক ডাকতে লাগল।
পরেশ তার মাথার কাছে বসে এখনো চুল টেনে দিচ্ছে। সে ঘুমাতে যাচ্ছে না। কারণ আজ রাত একটা অতি ভয়ংকর রাত। এই রাতে বিরাট ঝড় হবে সেটা ভয়ংকর কিছু না। ভয়ংকর ব্যাপার হল ঝড়ের ঠিক আগে আগে পরীবাণু গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন দেবে।
হইলদা বড়ি খাওয়ার কারণে পরেশ সবই জানে। এও জানে যে গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনাটা আটকানোর কোন উপায় নেই। উপায় থাকলে সে আটকাতো। হইলদা বড়ি তাকে শিখিয়েছে এই বিশ্ব ব্ৰহ্মাঞ্জে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা ঘটার সব ঘটে আছে। এর কোন কিছুরই কোন পরিবর্তন করা যাবে না। মানুষের কাজ শুধুই দেখে যাওয়া।