মাঝে মাঝে রাত এগারোটার দিকে মহসিন এই ঘরের দরজার পাশে এসে দাঁড়ান। কঠিন গলায় বলেন, দীপা ঘুমোচ্ছ?
দীপা বলেন, না, আসছি। ও বোধ হয় এখনো ভালোমতো ঘুমোয় নি।
দীপা খুব সাবধানে আলোর হাত ছাড়িয়ে উঠতে চান। আলো সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠে ক্রুদ্ধ গর্জন করে ওঠে এবং দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে। মহসিন ক্লান্ত গলায় বললেন, ওকে ঘুম পাড়াও। আমি শুয়ে পড়ছি।
তিনি কিন্তু শুয়ে পড়েন না। ঘরে বাতি জ্বলে। চুরুটের গন্ধ অনেক রাত পর্যন্ত ভেসে আসে। দীপার বড়ো মন খারাপ লাগে। অথচ কিছুই করার। নেই। যত বার তিনি উঠতে যান আলো ততবারই তাঁকে জাপটে ধরে।
আজ অবশ্যি আলো ঘুমাচ্ছে। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে গাঢ় ঘুম। হয়তো আজ জাগবে না। দীপা সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। বাতি নিভিয়ে নীল আলো জ্বলে দিলেন। পাশের ঘরে ঢুকলেন।
মহসিন বিছানায় শুয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পড়ছিলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আলো ঘুমোচ্ছ।
হুঁ।
জেগে যাবে না তো? একটা কোল বালিশ দিয়ে এসেছে?
হুঁ।
দীপা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। তাঁর অবশ্যি খুব অস্বস্তি লাগছে। মাঝরাতে এ ঘরে আসা, আস্তে আস্তে কথা বলা, ছিটকিনি লাগানো—সব কিছু মনে করিয়ে দেয় এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্যটি অন্য। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে শরীরে পৌছানো এক ব্যাপার, আর এরকম প্রস্তুতি নিয়ে এগোনো সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এতে নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হয়।
দীপা অস্বস্তি বোধ করছেন অস্বস্তি কাটানোর জন্যে তিনি অন্য গল্প শুরু করলেন, তোমার স্যারেরজীত সব পড়ে যাচ্ছে, জান?
না তো। দাঁত পড়ে যাচ্ছে?
উপরের পাটিতে একটি দাতও এখন নেই।
বল কি?
অদ্ভুত ব্যাপার না? নিচের পাটিতে সব দাঁত আছে অথচ উপরের পাটির একটা দাঁতও নেই। তোমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে না?
অদ্ভূত তো বটেই।
তিনি তাঁর স্ত্রীর কথা এখন তেমন মন দিয়ে শুনছেন না। তিনি দীপাকে আদর করতে শুরু করেছেন। পুরুষদের সেই বিশেষ আদর যা দীপার একই সঙ্গে ভালো লাগে এবং ভালো লাগে না।
দীপা বললেন, বাতি নিভিয়ে দাও না। লজ্জা লাগছে।
তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, একটু লজ্জা-লজ্জা লাগলে ক্ষতি নেই কিছু। বাতি থাকুক। বাতি না থাকলে কী করে বুঝব যে আমি এমন রূপবতী একটি মেয়ের পাশে বসে আছি। অন্ধকারে সব মেয়েই দেখতে এক রকম।
মহসিন ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকালেন। দুজনের ছায়া পড়েছে আয়নায়। দীপাকে কী সুন্দর লাগছে দেখতে। বয়সের কারণে নিতম্ব কিছুটা ভারী হয়েছে, তাতে দীপার রূপ যেন আরো খুলেছে।
দীপা বলল, আয়নার দিকে তাকিও না। আমার ভীষণ লজ্জা লাগে।
লাগুক।
মহসিন স্ত্রীর মুখে চুমু খেলেন আর তখনি আলো চিৎকার করে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ দরজায় এসে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দরজায় কিলঘুষি মারছে। দরজায় আঁচড়াচ্ছে, মাথা ঠুকছে। দরজায় ঝুলন্ত পৰ্দা দাঁত দিয়ে কুটিকুটি করে ফেলতে চেষ্টা করছে।
দীপা বললেন, মা আসছি, মা আসছি।
আলো তাঁর কথা শুনতে পেল না। তার পৃথিবী শব্দহীন। সে প্রবল আতঙ্কে দিশাহারা।
দীপা চট করে দরজা খুলতে পারলেন না। কাপড় গুছাতে তাঁর সময় লাগছে। এই সময়ে আলো একটা তাণ্ডব সৃষ্টি করল। একতলা থেকে বাবুর্চি এবং কাজের মেয়েটা ছুটে এল। তুষার এবং রাত্রির ঘুম ভেঙেছে। রাত্রি ভয় পেয়ে তার ঘর থেকে চেঁচাচ্ছে–কী হয়েছে? আম্মু, কী হয়েছে?
দীপা দরজা খুললেন। আশ্চর্য ব্যাপার। আলোর সমস্ত উত্তেজনার অবসান হয়েছে। সে কেমন যেন অবাক দৃষ্টিতে চারদিকে দেখছে। দীপা যখন তার হাত ধরলেন, তখনো সে অন্য বারের মতো মার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না, বরং এমন দৃষ্টিতে তাকাল যেন সে মাকে ঠিক চিনতে পারছে না। কিংবা বিরাট কোনো ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে যার তুলনায় মার উপস্থিতি খুবই তুচ্ছ ব্যাপার।
দীপা বললেন, এমন হৈচৈ শুরু করলে কেন, মা মণি? এরকম কর কেন তুমি?
আলো দীপাকে অবাক করে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়। বালিশে মুখ খুঁজে মূর্তির মতো হয়ে গেল।
দীপা তার পেছনে পেছনে এলেন। আলোর পিঠে হাত রাখলেন। আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। দীপা গাঢ় স্বরে বললেন, কী হয়েছে মা, কী হয়েছে?
আলোর যে কী হয়েছে তা সে নিজেও জানে না। আর জানতে পারলেও মা-কে জানানর সাধ্যও তার নেই। আজ সে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে। তার একান্ত নিজস্ব জগৎ ভেঙে খানখান হয়ে গেছে।
সে ঘুমুচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই তার মনে হল মা পাশে নেই। যার গায়ে সে হাত রেখেছে সে মা নয়। মার গায়ের পরিচিত উষ্ণতা সে পাচ্ছে না। মার গায়ের ঘ্রাণও নেই। তার ঘুম ভেঙে গেল। মা পাশে নেই। সে একটা কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে। আতঙ্কে তার বুক ধ করে উঠল। সে অবশ্যি চেঁচিয়ে উঠল না। নিজেকে সামলে নিল। মা নিশ্চয়ই বাথরুমে। সে বিছানা থেকে বাথরুমে উঁকি দিল। বাথরুমের দরজা খোলা। সেখানে কেউ নেই। মা তাহলে পাশের ঘরে? বাবার ঘরে? কেন, বাবার ঘরে কেন? তারা কী করে সেখানে? কান্নায় তার বুক ফুলে ফুলে উঠছে। সে বাবার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়াল। দরজায় অল্প ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে বন্ধ। কেন, ভেতর থেকে বন্ধ কেন? মা তাকে একা একা এই ঘরে ফেলে রেখে চলে গেছে? কেন সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে? কী করছে তারা দুজন?
আলো দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব রাগে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছা করছে পুরো বাড়িটা ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিতে। দাতু দিয়ে কামড়ে কুটিকুটি করে ফেলতে। ঠিক এরকম অবস্থায় কে একজন আলোর কাছে জানতে চাইল, কী হয়েছে তোমার? তুমি এরকম করছ কেন?