সুরুজ মিয়া বলল, উহুঁ। অবস্থা দেখতে না? রাস্তায় এক হাঁটু পানি।
তুষার দুঃখী-দুঃখী গলা বের করে বলল, সারা দিন তাহলে করব কী?
কি আর করবা, খেলাধুলা কর। তবে খবরদার পানিতে নামবা না। পানিতে নামলে বেগম সাব খুব রাগ করবেন।
তুষার কাগজের নৌকা বানাতে বসল। রাত্রি বসল গল্পের বই নিয়ে। তুষারের খুব ইচ্ছা করছিল পানিতে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা। একা একা পানিতে যেতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না। রাত্রি সঙ্গে থাকলে সে যেত। রাত্রি যাবে না। একবার গল্পের বই নিয়ে বসলে সে বই শেষ না করে ওঠে না। আজ যা মোটা বই হাতে নিয়ে বসেছে। এটা শেষ হতে হতে বৃষ্টি থেমে যাবে। পানি নেমে যাবে। এমন চমৎকার একটা ছুটি অথচ সে তেমন কোনো মজা করতে পারবে না।
তুষার নৌকা বানানর কাগজ নিয়ে বারান্দায় চলে এল। নৌকা বানিয়ে বানিয়ে বারান্দা থেকেই সে ছাড়বে। সাতটা নৌকা বানাবে। সপ্ত ডিঙ্গা মধুকর। দেখা যাবে নৌকাগুলি কত দূর যায়।
প্রথম নৌকা পানিতে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুষার লক্ষ করল, পানিতে নেমে ছপছপ শব্দ করে বাড়ির পেছনে যাচ্ছে। নিশানাথ স্যারের ঘরের দিকেই যাচ্ছে বোধ হয়।
তুষার ডাকল, এই আলো, এই।
আলো ডাক শুনল না। শুনবার কথাও নয়। সে একা একা কি রকম নির্বিকারভাবে যাচ্ছে। তার হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবে গেছে পানিতে।
তুষার মার কাছে চলে গেল।
দীপার মাথা ধরেছে। তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর মাইগ্রেনের ব্যথা আছে। মাঝে মাঝে এই ব্যথা তাঁকে কাবু করে ফেলে। আজও করছে। ঘর অন্ধকার করে তিনি শুয়ে আছেন।
তুষার বলল, মা, আলো একা একা বাড়ির পেছনে যাচ্ছে।
দীপা চুপ করে রইলেন।
পানি ভেঙে একা একা যাচ্ছে, মা।
যাক। তোমরা তাকে খেলায় নেবে না, কিছু করবে না, ও বেচারা একা একা কী করবে?
আমি কি ওকে নিয়ে আসব?
নিয়ে আসতে হবে না। ও কিছুক্ষণ খেলুক একা একা।
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তো।
ভিজুক। খানিকটা ভিজলে কিছু হয় না।
আমি খানিকটা ভিজে অসব, মা?
না, তোমাকে ভিজতে হবে না।
তুষার বেশ মন খারাপ করল। মার কাণ্ডটা সে বুঝতে পারছে না। একেক জনের জন্যে একেক ব্যবস্থা কেন? আলো যদি পানিতে ভিজতে পারে সে পারবে না কেন? বড়দের এইসব কোন ধরনের যুক্তি? মাকে যুক্তির ভুল ধরিয়ে দেবার সাহসও তার হল না। তার শুধু মনে হল, মা নিজে মেয়ে বলেই মেয়েদের বেশি আদর করেন।
নিশানাথ বাবু একটা আয়না হাতে নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছেন। তাঁর নিচের পাটির দাঁত পড়তে শুরু করেছে। আজ সকালে দাঁত মাজার সময় দুটো একসঙ্গে পড়ে গেল। আশ্চর্য কাণ্ড! নিজের মুখটা এখন কী যে কুৎসিত দেখাচ্ছে! কথাবার্তাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিছু বললে দাঁতের ট্র্যাক দিয়ে শব্দ বের হয়ে যাচ্ছে। হচ্ছেটা কী? নিশানাথ বাবু জানালা দিয়ে তাকালেন। এখনো বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি একটু কমলে এক জন ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। তার ধারণা হল, কোনো একটা ভিটামিনের অভাবে এরকম হচ্ছে। সেই ভিটামিনটা এখন খেলে কি বাকি দাঁতগুলি টিকবে?
আমি এসেছি।
নিশানাথ বাবু চমকে উঠলেন। আলো এসেছে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে কথা বলছে। মাথার মধ্যে কথা। নিশানাথ বাবু আলোর দিকে ফিরলেন। হাসলেন। যদিও দাঁত নেই মুখে হাসতে তাঁর লজ্জা লাগছে। তিনি আলোর সঙ্গে কথা শুরু করলেন। পুরো কথাবার্তা হল মাথার ভেতরে। কারো ঠোঁট নড়ল না। কেনো রকম শব্দ হল না। বাইরের কেউ দেখলে নিশ্চয় ভাবত–এরা দুজন দু জনের দিকে তাকিয়ে আছে কেন? তাদের কথাবার্তার শুরুটা এমন–
নিশানাথ : কেমন আছ?
আলো : আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
নিশানাথ : আমি ভালো নেই। দেখ নাকী কাণ্ড, আমার সব দাঁত আপনা-আপনি পড়ে যাচ্ছে।
আলে : আপনার কি অসুখ করেছে?
নিশানাথ : বুঝতে পারছি না। হয়তো করেছে। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এস, বস।
(আলো এসে বসল।)
আলো : আপনি আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেন অন্যর সেভাবে বলে না কেন?
নিশানাথ : পুরো ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না। আমার বোধ হয়। কোনো একটা বড়ো অসুখ হয়েছে। সেই অসুখের পর থেকে এই অবস্থা।
আলো : আমি আপনার কাছ থেকে পড়া শিখব।
নিশানাথ : বেশ তো শিখবে। অবশ্যি জানি না পারব কি না। পারতেও পারি। (নিশানাথ বাবু এই পর্যায়ে খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। তুষারের ইংরেজি শেখানোর ব্যাপারটা তাঁর মনে পড়ল।)
নিশানাথ : আলো, তুমি এক কাজ কর। চোখ বন্ধ করে থাক। আমি তোমার মাথার ভেতর চলে যাব। সেখানে থেকে শেখাব।
আলো : মাথার ভেতর কেমন করে যাবেন?
নিশানাথ ; জানি না। তবে আমি যেতে পারি।
আলো চোখ বন্ধ করে বসল। নিশানাথ বাবু মেয়েটির মাথার ভেতর অনায়াসে চলে গেলেন। তাঁর জন্যে বড়ো ধরনের একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। উজ্জ্বল আলোয় এই মেয়ের মাথার গহীন কুয়ো ঝলমল করছে। নিশানাথ বাবু মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গহীন কুয়ো দিয়ে নিচে নামতে নামতে তাঁর বারবার মনে হল, এই মেয়ে একটি অসাধারণ মেয়ে। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন এই মেয়ের কল্পনাশক্তি অসাধারণ, বোঝার ক্ষমতাও অসাধারণ।
নিশানাথ বাবুর রোমাঞ্চ বোধ হল। তাঁর ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে। তিনি আবার কথা বলা শুরু করলেন।
নিশানাথ : আলো, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
আলো: পারছি।
নিশানাথ : তুমি কি জান সব কিছুর নাম আছে?