ফেলুদা বলল, আমি ভাবছিলাম সাড়ে দশটার ট্রেনটার জন্য অপেক্ষা না করে এখনই বেরিয়ে পড়লে হয়তো ৩৭২ ডাউনটা ধরতে পারব।
তা বেশ তো, তোমাদের মতো শহুরে লোকেদের পল্লীগ্রামে বন্দি করে রাখতে চাই না আমি। তবে তুমি আসাতে আমি যে খুবই খুশি হয়েছি—সেটা আমার একেবারে অন্তরের কথা।
৪. পলাশী স্টেশনের দিকে যেতে
কাল রাত্তিরের বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে পলাশী স্টেশনের দিকে যেতে আমি সকাল বেলার রোদে ভেজা ধান ক্ষেতের দৃশ্য দেখছি, এমন সময় শুনলাম ফেলুদা ড্রাইভারকে একটা প্রশ্ন করল।
স্টেশনে যাবার কি এ ছাড়া আর অন্য কোনও রাস্তা আছে?
আজ্ঞে না বাবু, বলল মণিলাল ড্রাইভার।
ফেলুদার মুখ গম্ভীর। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি ও কী ভাবছে, কোনও সন্দেহের কারণ ঘটেছে কি না; কিন্তু সাহস হল না।
রাস্তায় কাদা ছিল বলে দশ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট লাগল স্টেশনে পৌঁছতে। মাল নামিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। ফেলুদা কিন্তু টিকিট ঘরের দিকে গেল না। মালগুলো স্টেশনমাস্টারের জিন্মায় রেখে আবার বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে এল।
রাস্তায় সাইকেল রিকশার লাইন। সবচেয়ে সামনের রিকশার মালিকের কাছে গিয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, এখানকার থানাটা কোথায় জানেন?
জানি, বাবু।
চলুন তো। তাড়া আছে।
প্রচণ্ডভাবে প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন দিতে দিতে ভিড় কাটিয়ে কলিশন বাঁচিয়ে আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে থানায় পৌঁছে গেলাম। ফেলুদার খ্যাতি যে এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সেটা বুঝলাম যখন সাব-ইন্সপেক্টর মিস্টার সরকার ওর পরিচয় দিতে চিনে ফেললেন। ফেলুদা বলল, ঘুরঘুটিয়ার কালীকিঙ্কত মজুমদার সম্বন্ধে কী জানেন বলুন তো।
কালীকিঙ্কর মজুমদার? সরকার ভুরু কুঁচকোলেন। তিনি তো ভাল লোক বলেই জানি মশাই। সাতেও নেই পাঁচেও নেই। তাঁর সম্বন্ধে তো কোনওদিন কোনও বদনাম শুনিনি।
আর তাঁর ছেলে বিশ্বনাথ? তিনি কি এখানেই থাকেন?
সম্ভবত কলকাতায়। কেন, কী ব্যাপার, মিস্টার মিত্তির?
আপনার জিপটা নিয়ে একবার আমার সঙ্গে আসতে পারবেন? ঘোরতর গোলমাল বলে মনে হচ্ছে।
কাদা রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে জিপ ছুটে চলল। ঘুরাঘুটিয়ার দিকে। ফেলুদা প্ৰচণ্ড চাপা উত্তেজনার মধ্যে শুধু একটিবার মুখ খুলল, যদিও তার কথা আমি ছাড়া কেউ শুনতে পেল না।
আরথ্রিাইটিস, সিন্দুকে দাগ, ডিনারে বিলম্ব, রাজেনবাবুর গলা ধরা, ন্যাফথ্যালিন–সর্ব ছকে পড়ে গেছে রে তোপ্সে। ফেলুমিত্তির ছাড়াও যে অনেক লোকে অনেক বুদ্ধি রাখে। সেটা সব সময় খেয়াল থাকে না।
মজুমদার-বাড়ি পৌঁছে প্রথম যে জিনিসটা দেখে অবাক লাগল সেটা হল একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। ফটকের বাইরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে এটাই নিঃসন্দেহে বিশ্বনাথবাবুর গাড়ি। জিপ থেকে নামতে নামতে ফেলুদা বলল, লক্ষ কর গাড়িটাতে কাদাই লাগেনি। এ গাড়ি সবেমাত্র রাস্তায় বেরোল।
বিশ্বনাথবাবুর ড্রাইভারই বোধহয়—কারণ এ লোকটাকে আগে দেখিনি—আমাদের দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে মুখ ফ্যাকাসে করে গেটের ধারে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি এ গাড়ির ড্রাইভার? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
আ-আজ্ঞে হ্যাঁ—
বিশ্বনাথবাবু আছেন?
লোকটা ইতস্তত করছে দেখে ফেলুদা আর অপেক্ষা না করে সোজা গিয়ে ঢুকল বাড়ির ভিতর–তার পিছনে দারোগা, আমি আর একজন কনস্টেবল।
আবার সেই প্যাসেজ দিয়ে গিয়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে ফেলুদা এবং আমরা তিনজন সোজা ঢুকলাম কালীকিঙ্করবাবুর ঘরে।
ঘর খালি। বিছানায় কম্বলটা পড়ে আছে। আর যা ছিল সব ঠিক তেমনিই আছে, কিন্তু মালিক নেই।
সর্বনাশ। বলে উঠল ফেলুদা।
সে সিন্দুকটির দিকে চেয়ে আছে। সেটা হা করে খোলা। বেশ বোঝা যাচ্ছে তার থেকে অনেক কিছু বার করে নেওয়া হয়েছে।
দরজার বাইরে গোকুল এসে দাঁড়িয়েছে। সে থরথর করে কাঁপছে। তার চোখে জল। দেখে মনে হয় যেন তার শেষ অবস্থা।
তার উপর হুমড়ি দিয়ে পড়ে ফেলুদা বলল, বিশ্বনাথবাবু কোথায়?
তিনি পিছনের দরজা দিয়া পালিয়েছেন।
দেখুন তো মিস্টার সরকার!
দারোগা আর কনস্টেবল অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে গেল।
শোনো গোকুল—ফেলুদা দুহাত দিয়ে গোকুলের কাঁধ দুটোকে শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল—একটিও মিথ্যে কথা বললে তোমায় হাজতে যেতে হবে। —কালীকিঙ্করবাবু কোথায়?
গোকুলের চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
আজ্ঞে—আজ্ঞে—তাঁকে খুন করেছেন।
কে?
ছোটবাবু।
কবে?
যেদিন ছাটবাবু এলেন সেদিনই। রাত্তির বেলা। বাপ-বেটায় কথা কাটাকাটি হল। ছোটবাবু সিন্দুকের নম্বর চাইলেন, কর্তাবাবু বললেন—আমার টিয়া জানে, তার কাছ থেকে জেনে নিয়ো, আমি বলব না। তারপরে-তারপরে—তার কিছুক্ষণ পরে—ছোটবাবু আর তেনার গাড়ির ডেরাইভারবাবু, দুজনে মিলে—
গোকুলের গলা ধরে এল। বাকিটা তাকে খুব কষ্ট করে বলতে হল—
দুজনে মিলে কর্তাবাবুর লাশ নিয়ে গিয়ে ফেলল ওই পিছনের দিঘির জলে—গলায় পাথর বেঁধে। আমার মুখ বন্ধ করেছেন ছোটবাবু-–প্ৰাণের ভয় দেখিয়ে!
বুঝেছি। —আর রাজেনবাবু বলে তো কোনও লোকই নেই, তাই না?
ছিলেন, তবে তিনি মারা গেছেন। আজ দুবছর হয়ে গেল।
আমি আর ফেলুদা এবার ছুটলাম নীচে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁইয়ে ঘুরলেই পিছনের বাগানে যাবার দরজা। বাইরে বেরোনো মাত্র মিস্টার সরকারের চিৎকার শুনলাম—-