- বইয়ের নামঃ জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. হ্যালো–প্ৰদোষ মিত্ৰ আছেন
হ্যালো–প্ৰদোষ মিত্ৰ আছেন?
কথা বলছি।
ধরুন–পানিহাটি থেকে কল আছে আপনার…হ্যাঁ, কথা বলুন।
হ্যালো–
আমার নাম শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরী। আমি পানিহাটি থেকে বলছি। আমি অবিশ্যি আপনার অপরিচিত, কিন্তু একটা বিশেষ অনুরোধ জানাতে আপনাকে টেলিফোন করছি।
বলুন।
আমার ইচ্ছা আপনি একবার এখানে আসেন।
পানিহাটি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি এখানেই থাকি। গঙ্গার উপরে আমাদের একটা একশো বছরের পুরনো বাড়ি আছে। নাম অমরাবতী। এখানে সকলেই জানে। আপনার কাজের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে, এবং আপনারা যে তিনজন একসঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তাও আমি জানি; আমি আপনাদের তিনজনকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এই শনিবার সকালে এসে—এই ধরুন দশটা নাগাদ-রাত্তিরটা থেকে আবার রবিবার ফিরে যাবেন।
কোনও অসুবিধায় পড়েছেন কি? মানে আমার পেশাটা তো জানেন; কোনও রহস্য—?
তা না হলে আপনাকে ডাকব কেন বলুন? তবে সে বিষয়ে আমি ফোনে বলব না, আপনি এলে বলব। আমার বাড়িটা আপনাদের ভালই লাগবে, ভাল ইলিশ মাছ খাওয়াব, যদি ভিডিও ক্যাসেটে ছবি দেখতে চান তাও দেখাব, আর তার উপরে আপনার মস্তিষ্ক খাটানার খোরাকও জুটবে বলে মনে হয়।
আমার অবিশ্যি এখন এমনিতে কোনও এনগেজমেন্ট নেই—।
তা হলে চলে আসুন।–দ্বিধা করবেন না। তবে একটা কথা।
কী?
এখানে আমি ছাড়াও কয়েকজন থাকবেন। গোড়ায় আমি কাউকে আপনার আসল পরিচয়টা দিতে চাই না—একটা বিশেষ কারণে।
ছদ্মবেশ নিয়ে আসতে বলছেন?
সেটার হয়তো প্রয়োজন নেই। আপনি তো ফিল্মস্টার নন। যাঁরা এখানে থাকবেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা আপনার চেহারার সঙ্গে পরিচিত নন। আপনি শুধু আপনাদের তিনজনের জন্য ভূমিকা বেছে নেবেন। কী ভূমিকা সেটাও আমি সাজেস্ট করতে পারি।
কীরকম?
আমার প্রপিতামহ বনোয়ারিলাল চৌধুরী ছিলেন এক বিচিত্র চরিত্র। তাঁর কথা পরে জানবেন, কিন্তু আমি এইটুকু বলতে পারি। যে তাঁর একটা জীবনী লেখা এমনিতেও বিশেষ দরকার। আপনি যদি ধরুন তাঁর সম্বন্ধে তথ্য সংগ্ৰহ করতে আসেন।
ভেরি গুড। আর আমার বন্ধু—মিঃ গাঙ্গুলী।
আপনার বাইনোকুলার আছে?
তা আছে।
তা হলে ওঁকে পক্ষিবিন্দ করে দিন না। আমার বাগানে অনেক পাখি আসে; ওঁর একটা অকুপেশন হয়ে যাবে।
বেশ। আমার খুড়তুতো ভাইটি হবেন পক্ষিবিদের ভাইপো।
ব্যাস, তা হলে তো হয়েই গেল।
তা হলে পরশু শনিবার সকাল দশটা?
দশটা।
আমরাবতী?
অমরাবতী। আর আমার নাম শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরী।
ফেলুদাকে অবিশ্যি টেলিফোনের পুরো ব্যাপারটা আমার জন্য রিপিট করতে হল। বলল, কিছু লোক আছে যাদের কণ্ঠস্বরে এমন একটা ভরসা-জাগানা হৃদ্যতাপূর্ণ ভাব থাকে যে তাদের অনুরোধ এড়ানো খুব মুশকিল হয়।
আমি বললাম, এড়াবে কেন? একে তো একরকম মক্কেল বলেই মনে হচ্ছে। তোমার রোজগারের কথাটাও ভাবতে হবে তো।
আসলে ফেলুদার একটা ব্যাপার আছে। পর পর গোটা দু-তিন কেসে ভাল রোজগার হলে কিছুদিনের জন্য গোয়েন্দাগিরিতে ইস্তফা দিয়ে অন্য জিনিস নিয়ে পড়ে। সে জিনিসে অবিশ্যি রোজগার নেই, শুধু শখের ব্যাপার। এখন ওর সেই অবস্থা চলেছে। এখনকার নেশা হল আদিম মানুষ। সম্প্রতি পূর্ব আফ্রিকার জীবতত্ত্ববিদ রিচার্ড লীকির একটা সাক্ষাৎকার পড়ে ও জেনেছে যে লীকির কিছু আবিষ্কারের ফলে আদিম মানুষের উদ্ভবের সময়টা এক ধাক্কায় লাখ লাখ বছর পিছিয়ে গেছে। ফেলুদা এখন আদিম মানুষ ও তার বানর পূব্যবস্থার ভাবনায় মশগুল। পাঁচবার গেছে মিউজিয়ামে, তিনবার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। আর একবার চিড়িয়াখানা। এক’দিন বলল, একটা থিওরিতে কী বলে জনিস? বলে মানুষ এসেছে আফ্রিকার এক বিশেষ ধরনের খুনে বানর থেকে, যাকে বলে কিলার এপ। আর সেই কারণেই নাকি মানুষের মজ্জায় একটা হিংস্ৰ প্ৰবৃত্তি রয়ে গেছে—যেটা প্রকাশ পায় যুদ্ধে, দাঙ্গায় আর খুন-খারাপিতে।
পানিহাটিতে মানুষের এই হিংস্র প্রবৃত্তির কোনও নমুনা ও আশা করছে কি না জানি না, তবে এটা জানি যে মাঝে মাঝে ওর কলকাতা ছেড়ে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য বাইরে ঘুরে আসতে ভালই লাগে। এইতো সেদিন আমরা লালমোহনবাবুর গাড়িতে গিয়ে বর্ধমানের রাস্তায় পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত ঐতিহাসিক গম্বুজ আর হিন্দু মন্দিরের উপরে তৈরি ষোড়শ শতাব্দীর মুসলমান মসজিদ দেখে এলাম।
লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু দশ দিনের ছুটিতে দেশে গেছেন বলে ফেলুদাকেই তাঁর জায়গা নিতে হল। পথে যেতে যেতে লালমোহনবাবু বললেন, দিলেন তো মশাই একটা দায়িত্ব আর একটা বাইনোকুলার আর দুখানা বই ঘাড়ে চাপিয়ে; এদিকে গড়পারে তো কাক চড়ুই ছাড়া কোনও পাখি কোনওদিন দেখিচি বলে মনে পড়ে না।
বই দুটো হল সেলিম আলির ইন্ডিয়ান বার্ডস আর অজয় হোমের বাংলার পাখি।
ফেলুদা বলল, কুছ পরোয়া নেহী। মনে রাখবেন, কাক হল করভাস স্প্লেন্ডেন্স, চড়ুই হল পাসের ডোমেস্টিকাস। সব সময় ল্যাটিন নাম বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে যাবে, তাই ইংরিজি নামও ব্যবহার করতে পারেন—যেমন ফিঙেকে ড্রঙ্গো, টুনটুনিকে টেলর বার্ড, ছাতারেকে জাঙ্গল ব্যাবলার। আর পাখি না দেখলেও, মাঝে মাঝে বাইনোকুলার চোখে লাগালেই অনেকটা কাজ দেবে।