- বইয়ের নামঃ ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ ফেলুদা সমগ্র
১. গ্ৰাম—ঘুরঘুটিয়া
গ্ৰাম—ঘুরঘুটিয়া
পোঃ—পলাশী
জেলা—নদীয়া
৩রা নভেম্বর ১১৭৪
শ্ৰীপ্ৰদোষচন্দ্ৰ মিত্ৰ মহাশয় সমীপেষু
আপনার কীর্তিকলাপের বিষয় অবগত হইয়া আপনার সহিত একটিবার সাক্ষাতের বাসনা জাগিয়াছে। ইহার একটি বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে। অবশ্যই। সেটি আপনি আসিলে জানিতে পরিবেন। আপনি যদি তিয়াত্তর বৎসরের বৃদ্ধের এই অনুরোধ রক্ষা করিতে সক্ষম হন, তবে অবিলম্বে পত্র মারফত জানাইলে বাধিত হইব।
ঘুরাঘুটিয়া আসিতে হইলে পলাশী স্টেশনে নামিয়া সাড়ে পাঁচ মাইল দক্ষিণে যাইতে হয়। শিয়ালদহ হইতে একাধিক ট্রেন আছে; তন্মধ্যে ৩৬৫ আপ লালগোলা প্যাসেঞ্জার দুপুর একটা আটান্ন মিনিটে ছাড়িয়া সন্ধ্যা ছটা এগারো মিনিটে পলাশী পৌঁছায়। স্টেশনে আমার গাড়ি থাকিবে। আপনি রাত্রে আমারই গৃহে অবস্থান করিয়া পরদিন সকালে সাড়ে দশটায় একই ট্রেন ধরিয়া কলিকাতায় ফিরিতে পরিবেন।
ইতি আশীর্বাদক
শ্ৰীকালীকিঙ্কর মজুমদার
চিঠিটা পড়ে ফেলুদাকে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘পলাশী মানে কি সেই যুদ্ধের পলাশী?’
আর কটা পলাশী আছে ভাবছিস বাংলাদেশে? বলল ফেলুদা।তবে তুই যদি ভাবিস যে সেখানে এখনও অনেক ঐতিহাসিক চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে, তা হলে খুব ভুল করবি। কিসু নেই। এমন কী সিরাজদ্দৌল্লার আমলে যে পলাশবন থেকে পলাশীর নাম হয়েছিল, তার একটি গাছও এখন নেই।
তুমি কি যাবে?
ফেলুদা চিঠিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, বুড়ো মানুষ ডাকছে এভাবে!—তা ছাড়া উদ্দেশ্যটা কী সেটা জানারও একটা কৌতুহল হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা—পাড়াগাঁয়ে শীতকালের সকাল-সন্ধেতে মাঠের উপর কেমন ধোঁয়া জমে থাকে দেখেছিস? গাছগুলোর গুড়ি আর মাথার উপরটা খালি দেখা যায়। আর সন্ধেটা নামে ঝাপ করে, আর তারপরেই কনকনে ঠাণ্ডা, আর—নাঃ, এ সব কতকাল দেখিনি। —তোপ্সে, দে তো একটা পোস্টকার্ড।
চিঠি পৌঁছাতে তিন-চার দিন লেগে যেতে পারে হিসেব করেই ফেলুদা যাবার তারিখটা জানিয়েছিল কালীকিঙ্কর মজুমদারকে। আমরা সেই অনুযায়ী ৩৬৫ আপ লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে পলাশী পীছলাম বারেই নভেম্বর রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায়। ট্রেনের কামরা থেকেই ধান ক্ষেতের উপর ঝাপ করে সন্ধে নামা দেখছি। স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন চারিদিকে বাতিটাতি জ্বলে গেছে, যদিও আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। কালেক্টরবাবুর কাছে টিকিট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যে গাড়িটা চোখে পড়ল সেটাই যে মজুমদার মশাইয়ের গাড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এরকম গাড়ি আমি কখনও দেখিনি; ফেলুদা বলল ছেলেবেলায় এক-আধটা দেখে থাকতে পারে, তবে নামটা শোনা এটুকু বলতে পারে। কাপড়ের হুডওয়ালা, অ্যাম্বাসডরের চেয়ে দেড় লম্বা আমেরিকান গাড়ি, নাম হাপমোবিল। গায়ের গাঢ় লাল রং এখানে ওখানে চটে গেছে, হুডের কাপড়ে তিন জায়গায় তল্পি, তাও কেন জানি গাড়িটাকে দেখলে বেশ সমীহ হয়।
এমন গাড়ির সঙ্গে উর্দিপরা ড্রাইভার থাকলে মানাত ভাল; যিনি রয়েছেন তিনি পরে আছেন সাধারণ ধুতি আর সাদা শার্ট। তিনি গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন, আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে সেটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মজুমদার বাড়িতে আপনারা?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা, ঘুরাঘুটিয়া।
আসুন।
ড্রাইভার দরজা খুলে দিলেন, আমরা চল্লিশ বছরের পুরানো গাড়ির ভিতর ঢুকে সামনের দিকে পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম। ড্রাইভার হ্যান্ডল মেরে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ঘুরাঘুটিয়ার দিকে রওনা করিয়ে দিলেন।
রাস্তা ভাল নয়, গাড়ির স্প্রিংও পুরনা, তাই আরাম বেশিক্ষণ টিকল না। তবুও, পলাশীর বাজার ছাড়িয়ে গাড়ি গ্রামের খোলা রাস্তায় পড়তেই চোখ আর মন এক সঙ্গে জুড়িয়ে গেল। ফেলুদা ঠিকই বলেছিল; ধানে ভরা ক্ষেতের ওপরে গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে, আর তারই আশেপাশে জমাটবাঁধা ধোঁয়া ছড়িয়ে বিছিয়ে আছে মেঘের মতো মাটি থেকে আট-দশ হাত উপরে। চারিদিক দেখে মনে হচ্ছিল একেই বোধ হয় বলে ছবির মতো
এরকম একটা জায়গায় যে আবার একটা পুরনা জমিদার বাড়ি থাকতে পারে সেটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না; কিন্তু মিনিট দশেক চলার পর রাস্তার দুপাশের গাছপালা দেখে বুঝতে পারলাম। আম জাম কাঁঠাল ভরা একটা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলেছি। তারপর রাস্তাটা ডান দিকে ঘুরে একটা পোড়ো মন্দির পেরোতেই সামনে দেখতে পেলাম নহবৎখানা সমেত একটা শেওলাধরা প্ৰকাণ্ড সাদা ফটক। আমাদের গাড়িটা তিনবার হর্ন দিয়ে। ফটকের ভিতরে ঢুকতেই সামনে বিশাল বাড়িটা বেরিয়ে পড়ল।
পিছনে সন্ধ্যার আকাশ থেকে লালটাল উবে গিয়ে এখন শুধু একটা গাঢ় বেগুনি ভাব রয়েছে। অন্ধকার বাড়িটা আকাশের সামনে একটা পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার অবস্থা যে প্রায় যাদুঘরে রাখার মতো সেটা কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম। দেয়ালে স্যাঁতা ধরেছে, সবঙ্গে পলেস্তারা খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে, সেই ইটের মধ্যেও আবার ফাটল ধরে তার ভিতর থেকে গাছপালা গজিয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে ফেলুদা প্রশ্ন করল, এদিকে ইলেকট্রিসিটি নেই বোধহয়? আজ্ঞে না। বলল ড্রাইভার, তিন বছর থেকে শুনছি। আসবে আসবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আসেনি।