- বইয়ের নামঃ ছিন্নমস্তার অভিশাপ
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ফেলুদা সমগ্র
০১. রামমোহন রায়ের নাতির সার্কাস ছিল
রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, রামমোহন রায়ের নাতির সার্কাস ছিল সেটা জানতেন?
ফেলুদার মুখের উপর রুমাল চাপা, তাই সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিল।
প্রায় দশ মিনিট ধরে পর্বতপ্রমাণ খড়বোঝাই লরি আমাদের যে শুধু পাশ দিচ্ছে না। তা নয়, সমানে পিছন থেকে রেলগাড়ির মতো কালো ধোঁয়া ছেড়ে প্রাণ অতিষ্ঠা করে তুলেছে। লালমোহনবাবুর গাড়ির ড্রাইভার হরিপদবাবু বার বার হর্ন দিয়েও কোনও ফল হয়নি। লরির পিছনের ফুলের নকশা, নদীতে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য, হর্ন প্লিজ, টা-টা গুডবাই, থ্যাঙ্ক ইউ সব মুখস্থ হয়ে গেছে। লালমোহনবাবু সাকার্স সম্বন্ধে বইটা কিছুদিন হল জোগাড় করেছেন; অনেক দিন আগের লেখা বই, নাম বাঙালির সাকাস। বইটা ওঁর ঝোলার মধ্যে ছিল, লরির জ্বালায় সামনে কিছু দেখবার জো নেই বলে সেটা বার করে পড়তে শুরু করেছেন। ইচ্ছে আছে সার্কাস নিয়ে একটা রহস্য উপন্যাস লেখার তাই ফেলুদার পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টা নিয়ে একটু পড়াশুনা করে রাখছেন। সকাসের কথা অবিশ্যি এমনিতেই হচ্ছিল, কারণ আজ সকালেই রাঁচি শহরে দ্য গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসের বিজ্ঞাপন দেখেছি। হাজারিবাগে এসেছে স্যাকস, আর আমরা যাচ্ছিও হাজারিবাগেই। ওখানে সন্ধেবেলা আর কিছু করার না থাকলে একদিন গিয়ে সার্কাস দেখে আসব সেটাও তিনজনে প্লান করে রেখেছি।
শীতের মুখটাতে কোথাও একটা যাবার ইচ্ছে ছিল; লালমোহনবাবুর নতুন বই পুজোয় বেরিয়েছে, তিন সপ্তাহে দু হাজার বিক্রি, ভদ্রলোকের মেজাজ খুশ, হাত খালি। নতুন বইয়ের নাম ভ্যানকুভারের ভ্যামপায়ার-এ ফেলুদার আপত্তি ছিল; ও বলেছিল। ভানুকভার একটা পোল্লায় আধুনিক শহর, ওখানে ভ্যাম্পায়ার থাকতেই পারে না; তাতে লালমোহনবাবু বললেন হৰ্নিমানের জিওগ্রাফির বই তন্নতন্ন করে ঘেঁটে ওঁর মনে হয়েছে। ওটাই বেস্ট নাম! ফেলুদা কোডাময়ি একটা তদন্ত করে এসেছে গত সেপ্টেম্বরে; মক্কেল সৰ্বেশ্বর সাহায়ের একটা বাড়ি আছে হাজারিবাগে, সেটা প্রায়ই খালি পড়ে থাকে, তাই ফেলুদার কাজে খুশি হয়ে ভদ্রলোক তাঁর বাড়িটা আফগার করেছেন দিন দশেকের জন্য। চৌকিদার আছে, সেই দেখাশুনা করে, আর তার বউ রান্না করে। খাওয়ার খরচ ছাড়া আর কোনও খরচ লাগবে না আমাদের।
লালমোহনবাবুর নতুন অ্যাম্বাড়াসাৰ্ডরেই যাওয়া ঠিক হল; বললেন, লং রানে গাড়িটা কীরকম সার্ভিস দেয় সেটা দেখা দরকার। গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড দিয়ে আসানসোল-ধানবাদ হয়ে আসা যেত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খড়গপুর-রাঁচি হয়ে আসাই ঠিক হল। খড়গপুর পর্যন্ত ফেলুদা চালিয়েছে, তারপর থেকে ড্রাইভারই চালাচ্ছে। গতকাল সকাল আটটায় রওনা হয়ে খড়গপুরে লাঞ্চ সেরে সন্ধ্যায় রাঁচি পৌঁছই। সেখানে অ্যাম্বার হোটেলে থেকে আজ সকাল নটায় হাজারিবাগ রওনা দিই। পঞ্চাশ মাইল রাস্তা, খালি পেলে সোয়া ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়, কিন্তু এই লরির জ্বালায় সেটা নির্ঘাত দেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে।
আরও মিনিট পাঁচেক হর্ন দেবার পর লরিটা পাশ দিল, আর আমরাও সামনে খোলা পেয়ে হাঁপ ছাড়লাম। দু পাশে বাবলা গাছের সারি, তার অনেকগুলোতেই বাবুইয়ের বাসা, দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পথের ধারেও টিলা পড়ছে। লালমোহনবাবু বই বন্ধ করে দৃশ্য দেখে আহা-বাহা করছেন আর মাঝে মাঝে বেমানান –রবীন্দ্ৰ-সংগীত গুনগুন করছেন, যেমন অস্ত্ৰাণ মাসে ফাগুনের নবীন আনন্দে। ওঁর চেহারায় গান মানায় না, গলার কথা ছেড়ে দিলাম। মুশকিল হচ্ছে, উনি বলেন কলকাতার ডামাডোল থেকে বেরিয়ে নেচারের কনট্যাক্টে এলেই নাকি ওঁর গান আসে, যদিও স্টক কম বুলে সব সময়ে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট গান মনে আসে না।
তবে এটা বলতেই হবে যে ওঁর দৌলতে এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাকার্স সম্বন্ধে অনেক তথ্য জেনে ফেলেছি। কে জানত আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালির সাকািস ভারতবর্ষে এত নাম কিনেছিল? সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল প্রোফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সাকিস। এই সাকর্মসে নাকি বাঙালি মেয়েরাও খেলা দেখাত, এমনকী বাঘের খেলাও। আর সেই সঙ্গে রাশিয়ান, আমেরিকান জামান আর ফরাসি খেলোয়াড়ও ছিল। গাস বার্নস বলে একজন আমেরিকানকে রেখেছিলেন। প্রোফেসর প্রিয়নাথ বোস বাঘ-সিংহ ট্রেনাড় করার জন্য। ১৯২০-এ প্রিয়নাথ বোস মারা যান। আর তারপর থেকেই বাঙালি সার্কাসের দিন ফুরিয়ে আসে।
এই গ্রেট ম্যাজেস্টিক কোন দেশি সার্কাস মশাই? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
দক্ষিণ ভারতীয়ই হবে, বলল ফেলুদা, সাকাসটা আজকাল ওদের একচেটে হয়ে গেছে।
ভাল ট্র্যাপিজা আছে কি না সেইটেই হচ্ছে প্রশ্ন। ছেলেবেলায় হামস্টোন আর কার্লেকার সাকৰ্ণসে যা ট্র্যাপিজ দেখিচি তা ভোলবার নয়।
লালমোহনবাবুর গল্পে নাকি ট্র্যাপিজের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। শূন্যে সব লোমহর্ষক খেলার মাঝখানে একজন ট্র্যাপিজের খেলোয়াড় ঝুলন্ত অবস্থায় আরেকজনকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে খুন করবে; রহস্যের সমাধান করতে হিরো প্রখর রুদ্রকে নাকি ট্র্যাপিজের খেলা শিখতে হবে। ফেলুদা শুনে বলল, যাক, একটা জিনিস তা হলে আপনার হিরোর এখনও শিখতে বাকি।