হরিচরণ থামল। ক্ষিতীশের দিকে এতক্ষণ সে তাকায়নি। দেখল মুচকি মুচকি হাসছে। তাইতে সে অস্বস্তি বোধ করে ধীরেন ঘোষ, প্রফুল্ল বসাক এবং বদু চাটুজ্জের মুখের দিকে তাকাল।
নস্যির কৌটো বার করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে বদু চ্যাটুজ্জে সিধে হয়ে বসল।
”প্রেসিডেন্ট স্যার, আমার একটা কথা বলার আছে। ট্রেনার যে হবে তার উপর ছেলেদের বা মেয়েদের শ্রদ্ধা থাকা চাই, আস্থা থাকা চাই। সে যেটা বলবে ওরা যেন নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজে সেটা করতে পারে। কিন্তু ক্ষিতীশ ওদের যা বলে সেটা ওরা বিশ্বাসভরে নিতে পারে কি?”
বদু চাটুজ্জে নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য কথা থামিয়ে রুমাল বার করল। নাক মুছল গভীর মনোযোগে। রুমাল পকেটে রাখল।
”ক্ষিতীশ নিজে কখনো সাঁতার কাটেনি। কমপিটিশনে কখনো নেমেছে বলে জানি না। ওর কথা ছেলেমেয়েরা কেন গ্রাহ্য করবে?”
”সে কি!” প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় অবাক হয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। ”আপনি সাঁতার জানেন না?”
ক্ষিতীশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”সাঁতার জানি না বলতে বদু নিশ্চয় মিন করছে, আমি কখনো কোন কমপিটিশনে মেডেল পাইনি। তাই না?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাই—ই বলছি।” ব্যস্ত হয়ে বদু বলল। ”কোচের রেপ্যুটেশন থাকা দরকার। নয়তো ছেলেমেয়েরা মানবে কেন? হরিচরণকে ওরা মানে কেন? ইন্ডিয়া চ্যামপিয়ান ছিল, অলিম্পিকেও গেছে। গঙ্গায় ১৩ মাইলের কমপিটিশন পর পর তিনবার জিতেছে।”
”আপনি ওলিম্পিকে গেছলেন!” বিনোদ ভড়ের বিস্মিত ভ্রূ কপাল বেয়ে চুলে গিয়ে ঠেকল।
কিঞ্চিৎ গদগদ স্বরে হরিচরণ বলল, ”লণ্ডনে ফরটি এইট ওলিম্পিকে আমি দেড় হাজার মিটারে ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করেছি। ওয়াটারপোলো টিমেও ছিলুম।”
”কি রেজাল্ট করেছিলেন?” প্রেসিডেন্ট ঝুঁকে পড়ল টেবলে।
হরিচরণ দ্রুত সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ”পয়েন্ট ফাইভ সেকেণ্ডের জন্য ব্রোনজটা মিস করেছি।”
হঠাৎ বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল ক্ষিতীশ। সবাই তার দিকে তাকাল।
কাশি থামিয়ে ক্ষিতীশ বলল, ”আই অ্যাম সরি। মাঝে মাঝে আমার এরকম হয়।”
প্রেসিডেন্ট বিরক্ত চোখ দুটো সরিয়ে নিয়ে আবার রাখল হরিচরণের মুখে।
”গোল্ড পেয়েছিল আমেরিকার ম্যাকলেন। জল থেকে উঠে আমায় বলেছিল, তুমি পাশে ছিলে তাই এত ভাল চার্জ পেয়েছি।”
”বটে বটে, তা আপনি কি বললেন?”
”আমি আর কি বলব, ওকে কনগ্র্যাচুলেট করে বললুম, ইন্ডিয়াতে যে টাইম করে এসেছি সেটা যদি আজ করতে পারতুম তাহলে…”
হরিচরণ থেমে গেল।
খুক খুক একটা শব্দ হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বিরক্ত হয়ে বলল, ”আবার আপনি কাশছেন? নিশ্চয় আপনার কাশির অসুখ আছে।”
ক্ষিতীশ মুখ নীচু করে ফিসফিসিয়ে বলল, ”হরি, গোল্ড না সিলভার, তাহলে কোনটা হত?”
হরিচরণ উত্তেজিত স্বরে বলল, ”মেডেলের কথা তো আমি বলিনি, তুমি হঠাৎ গায়ে পড়ে টিপ্পুনি কাটছ কেন?”
”জেলাসি।”
নস্যির কৌটোয় চাঁটা দিয়ে বদু মন্তব্য করল।
”ক্ষিতীশ বড় ফালতু কথা বলে।” কার্তিক সাহা এতক্ষণে মুখ খুলল। ”বারবার দেখেছি কখনই ও হরিকে সহ্য করতে পারে না।”
”জেলাসিই হোক ফেলাসিই হোক, আমাকে পাঁচজনের সামনে বিদ্রূপ করে তুমি কি আনন্দ পাও ক্ষিদ্দা বলো তো?”
ক্ষিতীশ চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে টেবলে রাখল। কঠিন স্বরে বলল, ”আমার বিরুদ্ধে আর কি অভিযোগ আছে ধীরেন?”
ধীরেন ঘোষ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে কয়েকটা কাগজ উল্টেপাল্টে বলল, ”এই সবই আর কি। অভিযোগ এনেছে সুইমাররা। ওরা বাইরেই আছে। প্রেসিডেন্ট যদি বলেন তো ওরা নিজেরাই এখানে এসে বলতে পারে।”
”না, তার দরকার নেই।” ক্ষিতীশ চশমাটা চোখে পরল, ”অভিযোগগুলি সত্যি।”
টেবলের মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কেউ মাথা নাড়ল, কেউ নড়েচড়ে বসল। ওদের ভাবভঙ্গিতে এই কথাটাই ফুটে উঠল—এইবার, তাহলে বাছাধন এইবার কি বলবে?
”আমি জানি ওরা কি বলবে। বলবে, আমি জলে নামি না, খাটতে বলি, না খাটলে গালাগালি করি। আপনারা বলবেন, আমি রেজাল্ট দেখাতে পারিনি তিন—চার বছর, আমার ব্যবহারে সুইমাররা বিদ্রোহ করেছে।”
”এমনকি মারবেও বলেছে।” যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য কথাটা বলেই, ধীরেন ও হরিচরণের ভ্রূকুটি দেখে থতমত হয়ে, ”কি কাণ্ড, এখনো চা দিয়ে গেল না।” বলতে বলতে উঠে বেরিয়ে গেল।
”অভিযোগের জবাব নিশ্চয় আমাকে দিতে হবে।”
প্রেসিডেন্ট গম্ভীর হয়ে বলল, ”সেটা আপনার ইচ্ছে। কিছু বলার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব।”
সারা ঘর উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। চশমাটা আবার টেবলে রেখে ক্ষিতীশ চোখ বোঁজে।
”এই ক্লাবে আমি প্রথম আসি পঁয়ত্রিশ বছর আগে। ধীরেনও তখন আসে। বছর পাঁচেক পর হরিচরণ। ওদের মত জুপিটারকে আমিও ভালবাসি। আমিও চাই জুপিটারের গৌরব, চাই ভারতের সেরা হয়ে উঠুক জুপিটার। এই গৌরব এনে দেয় সাঁতারুরা, ওয়াটারপোলো প্লেয়াররা, ডাইভাররা। ওদের পারফরমেন্স যত উঠবে, গৌরবও তত বাড়বে। আমার যা কিছু চেষ্টা, তা ওদের উন্নতির জন্যই। এজন্য আমি কঠোর হয়েছি, গালিগালাজও দিয়েছি।”
ক্ষিতীশের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল।
”সাঁতারে অবিশ্বাস্য রকমে পৃথিবী এগিয়ে গেছে। আর আমরা? আমাদের এক একটা রেকর্ডের বয়স দশ বছর পনেরো বছর। পঁচিশ বছর হতে চললো শচীন নাগের রেকর্ডের বয়স! কেন এই থমকে থাকা? যেভাবে পৃথিবী এগোচ্ছে, আমাদেরও সেইভাবে এগোতে হবে।”