শোবার ঘরের দেয়ালে ক্ষিতিশের বাবা—মা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং ম্যাগাজিন থেকে কেটে বাঁধানো মেডেল গলায় ডন শোলান্ডার ও ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দু’হাত তুলে দাঁড়ানো ডন ফ্রেজারের ছবি, পাশাপাশি টাঙানো। এ ছাড়া আছে—সাধারণত যা থাকে—খাট, আলমারি, বাক্স, আলনা এবং টুকিটাকি সাংসারিক জিনিস। পাশের ঘরে বই, ম্যাগাজিন, একটা তক্তপোশ এবং তার নীচে ট্রেনিংয়ের জন্য রবারের দড়ি, স্প্রিং, লোহা ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঘরে ক্ষিতীশ দুপুরে এক ঘণ্টা ঘুমোয়। পাখা নেই, বিছানা নেই। ওর মতে, চ্যামপিয়ন হতে গেলে শুধু শিষ্যকেই নয়, গুরুকেও কঠোর জীবন যাপন করতে হবে। অবশ্য তার কোন শিষ্য নেই।
তক্তপোশে শুয়ে চোখ বুঁজে ক্ষিতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিষ্য কোথায়!
ঘুম আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, ক্ষিতীশের আবছায়া চেতনায় ফুটে উঠল লম্বা দুটো হাত বৈঠার মত গঙ্গার জলে উঠছে আর পড়ছে।
মিলিয়ে গিয়ে নতুন আর একটি ছবি সে দেখল। ফণা তোলা কেউটের মত হিলহিলে কাদায় লেপা, সরু একটা দেহ। লম্বা লম্বা হাত এলোপাথাড়ি ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। ‘ফাইট’ কোনি, ফাইট।’
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ক্ষিতীশ অকারণেই অস্ফুটে উচ্চচারণ করল, ”কো ও ও নি।”
সম্ভবত নামটা তার ভাল লেগেছে।
।। ৩ ।।
টেবল টেনিস বোর্ডটায় কাপড় বিছিয়ে টেবল। সেটা ঘিরে সাত জন বসে। তার মধ্যে একটি চেয়ার খালি। ওরা চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ঘরের বাইরে কয়েকটি ছেলে, কার যেন প্রতীক্ষায়।
জুপিটার সুইমিং ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং এম এল এ বিনোদ ভড়, ডানদিকে ঝুঁকে সম্পাদক ধীরেন ঘোষকে বলল, ”একটাই অ্যাজেন্ডা, না আরো আছে?”
ধীরেন ঘোষ তার সরু গলাটি যথাসম্ভব লম্বা করে চশমার নীচের অংশের প্লাস পাওয়ারের মধ্য দিয়ে টেবলে রাখা কাগজের দিকে তাকাল।
”মেন আইটেম একটাই, আর যা আছে তা খুবই মাইনর।”
”কোরাম হয়েছে তো?”
”হ্যাঁ, সবাই হাজির।” ধীরেন ঘোষ এরপর ব্যস্ত হয়ে বলল, ”জগু, চা—সন্দেশ দিতে বল।”
যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র, তখনই দরজাটা খুলে গেল। ক্ষিতীশ সিংহ ঘরের প্রতিটি লোকের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি খালি চেয়ারটায় বসার আগে সভাকে নমস্কার জানাল।
জগু জিজ্ঞাসু চোখে ধীরেন ঘোষের দিকে তাকাল, মাথা হেলিয়ে ধীরেন ঘোষ বলল, ”একটু পরে আনবি।”
”আমার দেরী হয়ে গেল।” ক্ষিতীশ ফিকে হেসে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল।
”না না, মিনিট চারেক মাত্র দেরী হয়েছে।” বিনোদ ভড় ঘড়ি দেখে ধীরেন ঘোষকে বলল, ”আমার কিন্তু একটু তাড়া আছে।”
”নিশ্চয়, নিশ্চয়, এখুনি শুরু করছি। বেশিক্ষণ লাগার মত কিছুই নেই, শুধু সুইমারদের চিঠিটা ছাড়া। আর সেটা আগেই সারকুলেট করা হয়েছে, সুতরাং নতুন করে বলার কিছু নেই।”
”হ্যাঁ আছে।”
সবাই ক্ষিতীশের দিকে তাকাল।
”আমার বিরুদ্ধে চার্জগুলো স্পষ্ট করে চিঠিতে বলা নেই। সেগুলো জানতে চাই।”
সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।
বিনোদ ভড় বলল, ”ধীরেনবাবু, ওর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তাহলে বলুন।”
ধীরেন ঘোষ বিব্রতভাবে হরিচরণ মিত্তিরের দিকে তাকাল, হরিচরণ নড়ে—চড়ে বসল।
”ক্ষিদ্দা সম্পর্কে অভিযোগ ছেলেদের, মানে সুইমারদের। যারা সাত বছর, আট বছর আমাদের ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নামছে, মেডেল আনছে। মানে, আমাদের মুখোজ্জ্বল করছে।”
”বাজে কথা।” ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল, ”মেডেল হয়তো আনে কিন্তু মুখোজ্জ্বল করার মত কিছুই করেনি। শ্যামল চার বছর আগে এক মিনিট চার সেকেন্ডে হানড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল টানতো, এখনো তাই টানে। এটা কি মুখোজ্জ্বল করার মতো ব্যাপার?”
হরিচরণ কথাগুলো না শোনার ভান করে বলতে লাগল, ”এইসব সুইমাররাই হচ্ছে ক্লাবের প্রাণ। এদের নিয়েই ক্লাব টিকে আছে। এগিয়ে চলেছে। এরা উচ্ছ্বল, এরা চঞ্চল। এদের হ্যান্ডেল করতে হলে এদের মত হয়ে এদের সঙ্গে মিশতে হবে, বুঝতে হবে, আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হবে।”
”তার মানে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবে, পড়াশুনো করবে না, ট্রেনিং করবে না—একে উচ্ছলতা বলে মানতে হবে! এদের সঙ্গে তাল রেখে আমাকে আধুনিক হতে হবে, তবেই এদের হ্যান্ডেল করা যাবে?”
”কিন্তু ওদের মন—মেজাজ বোঝার ক্ষমতা, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ক্ষিদ্দার নেই।”
হরিচরণ সকলের মুখের দিকে তাকাল। তিন—চারটি মাথা নড়ে উঠল এক সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে। ক্ষিতীশের চোখ পিটপিট করতে লাগল, পুরু লেন্সের ওধারে।
”ক্ষিদ্দা জুনিয়ার ছেলেদের সামনেই শ্যামলকে তার টাইম আর আমেরিকার ১২ বছরের মেয়েদের টাইমের তুলনা করে অপমান করেছেন; গোবিন্দ এখনো ব্রেস্ট স্ট্রোকে বেঙ্গল রেকর্ড হোল্ড করছে, লাস্ট ইয়ারেও বোমবাই ন্যাশনালে গেছল, তাকে বলেছেন কান ধরে ক্লাব থেকে বার করে দেবে। সুহাস ইনফ্লুয়েঞ্জায় পড়ে দিন দশেক আসতে পারেনি। তার বাড়িতে গিয়ে ক্ষিদ্দা সুহাসের বাবাকে যা তা কথা বলে এসেছেন। অমিয়া আর বেলা জুপিটার ছেড়ে অ্যাপোলোয় গেছে শুধুই ক্ষিদ্দার জন্য। উনি ওদের চুল কাটতে চেয়েছিলেন। পুরুষদের মত ওদেরও বারবেল নিয়ে একসারসাইজ করার জন্য ঝগড়া করতেন। ওদের ড্রেস, ওদের সাজ নিয়ে রোজই খিটখিট করতেন। লাস্ট ইয়ারে আপনারা দেখেছেন, ওই দুটি মেয়ের জন্যই স্টেট মিটে অ্যাপোলো টিম চ্যাম্পিয়নশিপ পায়।”