”ক্ষিদ্দা, তোমার এই লেকচার দেবার বদ অব্যেসটা ছাড়ো। এককথায় যেখানে কাজ হয়, তুমি সেখানে দশ কথা বলো। হরিচরণদাকে অত কথা বলার কি দরকার ছিল। যাকগে, আজ তুমি মিটিংয়ে যেও না, ওরা ঠিক করেছে তোমাকে অপমান করবে।”
”করে করবে।” এই বলে ক্ষিতীশ তার পায়ে মাথা ঘষায় ব্যস্ত বিশুকে কোলে তুলে গলা চুলকে দিতে লাগল। চোখ বুঁজে বিশু ঘরর ঘরর শুরু করল।
”তাহলে যাবেই!” নেমে যাওয়া প্যান্ট এবং কণ্ঠস্বর হ্যাঁচকা দিয়ে টেনে তুলে ভেলো বলল।
ক্ষিতীশ ঘরের দিকে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল, ”হুঁ।”
তখনই বাড়িতে ঢুকল লীলাবতী সিংহ। অতি ছোট্টখাট্ট, গৌরবর্ণা এবং গম্ভীর। পায়ে চটি, হাতে ছাতা। দু’জনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে ভেলোকে বলল, ”বেলা অনেক হয়েছে, চাট্টি ভাত খেয়ে যেও।”
ভেলোর হঠাৎ যেন কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল। ঘড়ি দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল, ”না না বৌদি, ইসস বড্ড দেরী হয়ে গেল। বাড়িতে ভাত নিয়ে বসে আছে। আমি এখন যাই। ক্ষিদ্দা, তোমার কিন্তু না গেলেই ভাল।”
ভেলো চলে যেতেই লীলাবতী প্রশ্ন করল ক্ষিতীশকে ”না গেলেই ভাল মানে?”
”আজ ক্লাবের একটা মিটিং আছে। ও বলছে সেখানে আমাকে নাকি কেউ কেউ অপমান করবে যাতে ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই।”
”তাহলে তো ভালই হয়। ক্লাব—ক্লাব করে তো কোনদিন ব্যবসা দেখলে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকেই কিনা দোকান দেখতে হয়। নেহাত ছেলেপুলে নেই তাই। যদি ক্লাব তোমায় তাড়ায় তাহলে আমি বেঁচে যাই।”
লীলাবতী রান্নাঘরে ঢুকল। ক্ষিতীশ বিষণ্ণ চোখে দালানে বসে বিশুর মাথায় আনমনে হাত বোলাতে লাগল। এই সময় খুশি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডন দিয়ে, হাই তুলে ধীরে ধীরে সে চামরের মত কালো লেজটি উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল ক্ষিতীশের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে।
”কই এসো।” রান্নাঘর থেকে ডাক এল।
ক্ষিতীশ অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে গিয়ে ভাত খেতে বসল।
খাওয়ার আয়োজন সামান্য। রান্না হয় কুকারে। প্রায় সবই সিদ্ধ। এটা খরচ, সময় ও শ্রম সংক্ষেপের জন্য নয়। ক্ষিতীশ বিশ্বাস করে, বাঙালিয়ানা রান্নায় স্বাস্থ্য রাখা চলে না। এতে পেটের বারোটা বাজিয়ে দেয়। সেইজন্যই বাঙালীরা শরীরে তাগদ পায় না, কোন খেলাতেই বেশি উঁচুতে উঠতে পারে না। খাদ্যপ্রাণ যথাসম্ভব অটুট থাকে সিদ্ধ করে খেলে এবং সর্বাধিক প্রোটিন ও ভিটামিন পাওয়া যায় এমন খাদ্যই খাওয়া উচিত।
প্রথম দিকে লীলাবতী বিদ্রোহী হয়েছিল, সরষে বাটা, শুকনো লঙ্কাবাটা, পাঁচফোড়ন, জিরে, ধনে প্রভৃতি বস্তুগুলি রান্নায় ব্যবহারের সুযোগ হারিয়ে। তুমুল ঝগড়া এবং তিনদিন অনশন সত্যাগ্রহেও কাজ হয়নি। ক্ষিতীশ তার সিদ্ধান্তে গোঁয়ারের মত অটল থাকে। তার এক কথা : ‘শরীরের নাম মহাশয় যা সহাবে তাই সয়।” অবশেষে লীলাবতী সপ্তাহে একদিন সরষে ও লঙ্কাবাটা ব্যবহারের অনুমতি পায়, শুধুমাত্র নিজের খাবারের জন্য। ক্ষিতীশ কখনো যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণে যায় না। ক্লাবের ছেলেমেয়েদের সে প্রায়ই শোনায়: ‘ডাক্তার রায় বলতেন, বিয়ে বাড়ির এক একটা নেমন্তন্ন খাওয়া মানে এক এক বছরের আয়ু কমে যাওয়া। বড় খাঁটি কথা বলে গেছেন।’
ক্ষিতীশ কথা না বলে খাওয়া শেষ করল।
ও যে রাগ করেছে লীলাবতী বুঝতে পেরেছে। বলল, ”ক্লাব থেকে তাড়াবে কেন? কি দোষ করলে?”
ক্ষিতীশ পাল্টা প্রশ্ন করল, ”তুমি এখন আবার দোকানে গেছলে কেন?”
গ্রে স্ট্রিটে ট্রামলাইন ঘেঁষে একফালি ঘরে দোকানটি। নাম ‘প্রজাপতি’। আগে নাম ছিল ‘সিনহা টেলারিং’। দুটি দর্জিতে জামা—প্যান্ট তৈরী করত, আর দেয়াল আলমারিতে ছিল কিছু সিন্থেটিক কাপড়। ক্ষিতীশ তখন দোকান চালাত। দিনে দুঘণ্টাও দোকানে বসত না। দুপুর বাদে তাকে সর্বদাই পাওয়া যেত জুপিটার সুইমিং ক্লাবে। তারপর একদিন সে আবিষ্কার করল আলমারির কাপড় অর্ধেকেরও বেশি অদৃশ্য হয়েছে, দোকানের ভাড়া চার মাস বাকি এবং লাভের বদলে লোকসান শুরু হয়েছে।
তখনই লীলাবতী হস্তক্ষেপ করে, দোকানের দায়িত্ব নেয়। টেলারিং ডিপ্লোমা পাওয়া দুটি মহিলাকে নিয়ে সে দোকানটিকে ঢেলে সাজায় নিজের গহনা বাঁধা দিয়ে। নাম দেয় ‘প্রজাপতি’। পুরুষদের পোশাক তৈরী বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র মেয়েদের এবং বাচ্চচাদের পোশাক তৈরী করে। দোকানে পুরুষ কর্মচারী নেই এবং চার বছরের মধ্যেই ‘প্রজাপতি’ ডানা মেলে দিয়েছে। আগে তিনদিনে ব্লাউজ তৈরী করে দেওয়া হত, এখন দশদিনের আগে সম্ভব হচ্ছে না। লীলাবতী তার গহনাগুলির অর্ধেকই ফিরিয়ে এনেছে।
”এখন তো আর জায়গায় কুলোয় না, তাই বড় ঘর খুঁজছি। হাতিবাগানের মোড়ে একটা খোঁজ পাওয়া গেছে। আমাদেরই এক খদ্দেরের বাড়ি। বাড়ির গিন্নি এসেছিল মেয়ের ফ্রক করাতে। তাই গেছলুম কথা বলতে।” লীলাবতী এঁটো থালাটা টেনে নিয়ে তাতে ভাত বেড়ে, ডাল মাখতে মাখতে বলল।
ক্ষিতীশের প্রবল আপত্তি ছিল তার খাওয়া থালায় লীলাবতীর ভাত খাওয়ায়। ‘আনহাইজীনিক। এইসব কুসংস্কারেই বাঙালী জাতটা গোল্লায় গেল।’ এই বলে ক্ষিতীশ তর্ক শুরু করেছিল। কিন্তু লীলাবতী যখন অতিরিক্ত ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘এটা আমার ব্যাপার, মাথা ঘামিও না।’ তখন মুহূর্তে বুঝে যায় আর কথা বাড়ালে তাকেই গোল্লায় যেতে হবে। তবে ক্ষিতীশ তার প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। লীলবতীর খাওয়ার সময় তাই কখনোই সে সামনে থাকে না।