ওরা কাঁধে করে অনাদিকে টেন্টে আনল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় বকুদার চোখ দিয়ে শুধু জল ঝরে পড়ছে। ইউনাইটেডের খেলোয়াড়রা অবাক চোখে বারবার এখনও তার দিকে তাকাচ্ছে, আর খেলার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে আবোল তাবোল কথা বলে যাচ্ছে। ওরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা। কে একজন বলল, ”ব্র্যাডম্যানের চব্বিশ বলে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটি নিশ্চয়ই ভাঙতে পারতেন, যদি না উইন হয়ে যেত।” আর একজন বলল, ”এ খেলার গল্প কাউকে করলে বলবে গাঁজায় দম দিয়ে বলছি। ফ্যান্টাস্টিক! আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম, সতেরো বলে ছিয়াত্তর রান!”
অনাদি চুপ করে বসে আছে। বিরাট এক বিস্ময়ের কেন্দ্রমধ্যে অবস্থান করার অনুভব সে বোধ করছে। এক বিচিত্র ঘূর্ণিতে পাক খাওয়ার আনন্দে তার ভিতরটা টলছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, টেন্টের বাইরে বেঞ্চে তরুণীটি বিষণ্ণমুখে বসে, পাশে বাচ্চচা ছেলেটি। তার আনন্দের রেশটা ওই বিষণ্ণ মুখ ছিঁড়ে দিল যেন। মুখ ফিরিয়ে অন্যত্র দৃষ্টিনিবদ্ধ করেও সে রেহাই পেল না। একটা পাষাণভার ক্রমশই তার বুকে চেপে ধরেছে।
অবশেষে অনাদি তরুণীর কাছে দাঁড়াল। পকেট থেকে আংটিটা বার করে এগিয়ে ধরে বলল, ”এটা কি আপনার?”
”হ্যাঁ, এই তো!” বিষণ্ণতা মুহূর্তে খুশিতে ফেটে পড়ল। ”পেলেন কি করে? বাবা! বাবা! পেয়েছি।” চিৎকার করে উঠল তরুণীটি।
”এই বেঞ্চের তলাতেই পড়েছিল। তখুনি বলব ভেবেছিলুম, কিন্তু এমন তাড়াহুড়োর মধ্যে ব্যাট করতে যেতে হল যে—”
”ওহ, কী দারুণ যে ব্যাট করেছেন, ভাবাই যায় না… অকল্পনীয়, সত্যি বলছি আংটির কথাটা তখন একদম ভুলেই গেছলাম।”
বাচ্চচা ছেলেটি বলল, ”কাল কাগজে আপনার নাম বেরোবে, না?”
অনাদি মাথা নামিয়ে মৃদু মৃদু হাসল, তারপর ফিরে এল। বকুদা চায়ের কাপ এগিয়ে ধরে বলল, ”সামনের রোববার শোভাবাজারের সঙ্গে খেলা, আসছেন তো?”
অনাদি উত্তর দেবার আগেই একজন ডাকল, ”বকুদা, একটুখানি আসুন তো, কাগজের জন্য খবরটা কীভাবে লিখব বলে দিয়ে যান।”
ব্যস্ত হয়ে বকুদা স্থান ত্যাগ করতেই অনাদি আপনমনে হাসল। ভেবেছিল সকলের হাতে ধোলাই খাবে, কিন্তু বদলে পাচ্ছে তারিফ আর আপ্যায়ন। এখন নিজেকে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছে তার। আংটিটা ফেরত না দিলে, বিক্রি করে কয়েকটা টাকা পাওয়া যেত বটে, কিন্তু এই অনুভবের মধ্যে মহৎ না হয়ে উপায় কি!
নিজের ব্যাগটা ছাতে নিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। তখন তার কানে এল বকুদার কথাগুলো—”ভালোভাবে রিকোয়েস্ট করে বোলো, যাতে অঞ্জন বিশ্বাস নামটা বোল্ড টাইপে ছাপায়।”
শুনে অবাক হয়ে গেল অনাদি। কে অঞ্জন বিশ্বাস? তারপরই মনে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের সম্পর্কে বিস্ময়জনিত যাবতীয় অনুভব থেকে বঞ্চিত হয়ে সে বোকার মতো হাসল এবং নিজেকে শুনিয়ে বলল, ”যাচ্চচলে, আমায় লোকসান করিয়ে মাঝ থেকে সব ক্রেডিট নিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যাটা!”
এরপর অনাদি কাউকে কিছু না বলে টেন্ট থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।