তখন সেই তরুণীটিকে টানতে টানতে বাচ্চচা ছেলেটি ব্যাট হাতে হাজির হল। অনাদি অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেও কৌতূহলে তাকিয়ে রইল। ওকে দেখে তরুণীটি ঈষৎ বিব্রত হয়ে ছেলেটিকে বলল, ‘বুলু, অসভ্যতা করো না। হাত ছাড়ো, বলেছি তো খেলব।”
”আগে তুমি ব্যাট করো।”
তরুণী তার হাতের ব্যাগটি কোথায় রাখবে ভেবে চারিদিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে; ছেলেটি ছোঁ মেরে তার হাত থেকে নিয়ে ছুটে অনাদির কাছে, বলল, ”দিদির ব্যাগটা রাখুন তো।”
”আমি যে এখুনি যাব ব্যাট করতে।” অনাদি ঝুটঝামেলা এড়াবার জন্য বলল। ছেলেটি ওর কথায় কর্ণপাত করল না। ঘাড় ফিরিয়ে অনাদি খুবই বিরক্তচোখে ওদের এলেবেলে খেলা দেখতে লাগল। ছেলেটির প্রত্যেকটি বলই ফস্কে যাচ্ছে, তরুণী কুড়িয়ে আনছে, এবং মুখ লাল করে আবার ব্যাট হাতে দাঁড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে অনাদি অন্যমনস্কের মতো ব্যাগটির ঢাকনার স্প্রিং—এ চাপ দিতেই মুখটা ফাঁক হয়ে গেল। চমকে সে ঢাকনাটা বন্ধ করে এধার ওধার তাকাল। কেউ দেখছে না তাকে, তবু দুরদুর করে উঠল ওর বুকের মধ্যে। অবশ—হাতে ব্যাগটা কোলের উপর রেখে অনাদি ওদের খেলার দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরই তার আঙুলগুলো কেঁপে উঠল। ঢাকনার স্প্রিং টিপল সন্তর্পণে। রুমাল, চিরুনি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তার আঙুল দ্রুত ব্যাগের তলদেশে পৌঁছল। বৃত্তাকার, কঠিন একটি জিনিসের স্পর্শ পেতেই তার মনে হল নিশ্চয় আংটি! দুই আঙুলে সেটিকে চিমটের মতো ধরে, তরুণী ও ছেলেটির খেলার দিকে স্থির—চোখে তাকিয়ে থেকে, টেনে বার করে এনেই ট্রাউজার্সের পকেটে রেখে ব্যাগটি বন্ধ করল। তারপর সতর্ক—দৃষ্টিতে চারধারে তাকিয়ে আশ্বস্ত বোধ করতে করতে উত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। খেলার মাঠ থেকে সোরগোলের যে শব্দটা অনাদি এতক্ষণ শুনতে পাচ্ছিল না, ক্রমশ সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
”একি, আপনি এখানে!” হন্তদন্ত হয়ে বকুদা হাজির হল। ”ছটা উইকেট পড়ে গেছে, জানেন না? এখনও প্যাড পরেননি!”
”হ্যাঁ, এই যাই”—অনাদি ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ”খোকা! ব্যাগটা রইল।”
শামিয়ানার তলায় প্যাড পরতে পরতে অনাদি খুব ঝরঝরে বোধ করল। বকুদা ওর পাশে বিড়বিড় করে যাচ্ছে—”আর কুড়ি মিনিট বাকি। কাটিয়ে দাও, মদনমোহন! বুঝলেন, রানের কোনো দরকার নেই। কোনো রিস্ক নেবেন না। স্টাম্পের বাইরের বলে একদম ব্যাট ঠেকাবেন না। হে মদনমোহন! আর আঠারো মিনিট। অনেকক্ষণ টাইম নেবেন ফিল্ড দেখার জন্য, মাঝে মাঝে প্যাডের বকলেশ ঠিক করবেন, বদলাবার জন্য ব্যাট চাইবেন। আর—”মাঠের মধ্যে হঠাৎ বীভৎস চিৎকার ওঠায় বকুদার কথা থেমে গেল। ইছাপুরের সপ্তম উইকেটটি পড়ল লোপ্পাই ক্যাচ দিয়ে। নবম ব্যাটসম্যান নামতে চলেছে, বকুদা ভগ্নস্বরে বলল, ”আর পনেরোটা মিনিট আছে রে।”
অনাদি দেখছিল, আড়ষ্ট—পায়ে, ভীতচোখে এধার—ওধার তাকাতে তাকাতে কেমন করে ব্যাটসম্যানটি উইকেটের দিকে চলেছে। ওর হাসি পেল। ভাবল, আমার তো আসল কাজ হয়েই গেছে। উইকেটে যাব আর চলে আসব। হার—জিত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আসলে ব্যাট করবে তো অঞ্জন বিশ্বাস। স্কোরবুকে ওই নামই তো লেখা আছে।
”আমার স্পষ্ট মনে আছে, ব্যাগের মধ্যেই রেখেছিলাম।”
অনাদি চমকে উঠল পিছন—থেকে বলা সেই তরুণীর কণ্ঠস্বরে।
”তাহলে যাবে কোথায়!” ভারী একটি পুরুষ—কণ্ঠ উদ্বেগ ও বিরক্তি—সহকারে বলল, ”আর একবার ভালো করে ব্যাগটা দেখ।”
”তিন—চারবার তো দেখলাম।”
”ব্যাগটা কোথায় রেখেছিলে?”
অনাদি পাথরমূর্তির মতো বসে। ওর মনে হল, একজোড়া চোখ তার দিকে তাকাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালেই চোখাচোখি হবে। চোখদুটো নিশ্চয় তাকে সন্দেহ করছে। এইবার হয়তো বলবে, উঠে আসুন তো, আপনাকে আমরা সার্চ করব। আপনি ছাড়া আর কে নিতে পারে? তারপর ওরা শেষ ব্যাটসম্যানকে যেভাবে ফিল্ডাররা ঘিরে ধরে সেইভাবেই গোল হয়ে ঘিরে ধরবে। তারপর ওদের একজন এগিয়ে আসবে।
পালাতে হবে। এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে হবে। অনাদির মাথার মধ্যে শুধু এই কথাটিই পাগলা ঘণ্টির মতো বেজে চলল। কিন্তু কোন দিক দিয়ে কীভাবে পালাবে! এতদিন একবারও সে ধরা পড়েনি।
মাঠে আবার একটা হিংস্র উল্লাস ফেটে পড়ল। বকুদা অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে বলে উঠল, ”আর বারোটা মিনিট মাত্র।” অনাদি ছিটকে উঠে দাঁড়াল। ব্যাটটা হাতে তুলে নিয়ে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে, মাঠের মাঝখানে যাবার জন্য সে প্রায় ছুটতে শুরু করল।
ওভারের চারটি বল বাকি ছিল। বুক এবং পেট দিয়ে দুটি বল সে আটকাল এল. বি. ডবলু—র ফাঁড়া কাটিয়ে। তৃতীয় বল ওর ব্যাট ছুঁয়ে দু—জন স্লিপ ফিল্ডারের মধ্যে দিয়ে গলে যেতেই অপর ব্যাটসম্যানের নিষেধ অগ্রাহ্য করেই এক রান নিতে ছুটল এবং অল্পের জন্য রান আউট হওয়া থেকে বাঁচল।
এরপরই অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর ব্যাপার ঘটে গেল। অনাদি তেত্রিশ রান করল এই ওভারে। পাঁচটি ওভারবাউন্ডারি ও একটি তিন। পরের ওভারে ত্রিশ রান। পাঁচটি ওভারবাউন্ডারি। শেষ বলটি ব্যাটে লাগেনি এবং উইকেটকিপারও ফস্কায়, তাইতে ওরা একটি বাই রান নেয়। খেলার শেষ ওভারে অনাদি আরও দুটি ওভারবাউন্ডারি মারার পরই দেখল মাঠের বাইরে থেকে ইছাপুরের খেলোয়াড়রা তার দিকে ছুটে আসছে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে।