”তাহলে এত বড় গড়ের মাঠে আর কি করে বার করবেন।” লোকটিকে অনাদির থেকেও বেশি হতাশ মনে হল। ”আপনি খুঁজছেন ক্লাব, খেলবেন বলে, আর আমার ক্লাব খুঁজছে তার প্লেয়ারদের! কাল তিনজন একসঙ্গে বরযাত্রী গেছে রানাঘাটে, বলে গেছে ঠিক সময় মাঠে পৌঁছব। আর এখন দশটা বাজতে….”
টেন্টের মধ্যে থেকে সাদা—কোট—পরা আম্পায়ারকে বেরিয়ে আসতে দেখে টাকমাথা চুপ করে গেল। ”আর দু—মিনিট স্যার। আমি আপনার হাতে লিস্ট দিয়ে আসব। জাস্ট দু—মিনিট। বুঝতেই তো পারছেন এক মুশকিলে পড়েছি।”
আম্পায়ার হাতঘড়ি দেখে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। লোকটি কিছুটা আপন মনে কিছুটা অনাদিকে উদ্দেশ করে কাতরস্বরে বলল, ”সাত সকালে মাংস রান্না করে, হাঁড়ি—কুড়ি, কাপ—ডিস—প্লেট, খেলার ব্যাট—প্যাড—এত লটবহর নিয়ে যদি ইছাপুর থেকে আসতে পারি, আর বাবুরা নেমন্তন্ন খেয়ে… ঘণ্টু ছাড়া তো মোটে ন’জন হাজির হয়েছে। ঘণ্টু স্কোর লিখবে, আরে ধ্যেৎ… এভাবে কি ক্লাব চালানো যায়!”
টেন্ট থেকে চারটি ছেলে ব্যাট আর বল নিয়ে বেরিয়ে গাঁদা গাছের পাশে খুটখাট শুরু করল। মাঠের ধারে খাটানো সামিয়ানার পাশে কয়েকজন বল লোফালুফি করছে। পাশের মাঠের সাইট স্ক্রিন বাতাসে খুলে বাঁশে ঝুলছে। পাশের টেন্ট থেকে ভারী গলায় মালিকে ধমক দেবার শব্দ এল। অনাদির শীত করছে। রোদ্দুরে মাঠের ধারে ঘাসের উপর এখন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে আরাম।
”বকুদা, তাহলে কী হবে?” কাগজ আর কলম হাতে, বুটের খড়মড় আওয়াজ তুলে একজন এসে দাঁড়াল। ”ইউনাইটেড তো অনেকক্ষণ টিম সাবমিট করে দিয়েছে।”
অনাদি এগিয়ে গেছে খানিকটা। টাকমাথা লোকটি অর্থাৎ বকুদা ছুটে এসে ওর হাত ধরল। ”কোথায় বা হাতিবাগান স্পোরটিংকে খুঁজে বেড়াবেন, তার চেয়ে আজ আমাদের হয়েই খেলে যান। নামটা কি বলুন তো, লিগে আর কোন ক্লাবের হয়ে খেলেননি তো? আর খেললেই বা কেউ ধরতে পারবে না। বরং একটা ফলস নামেই খেলুন, কেমন?”
অনাদিকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে বকুদা ঘষঘষ করে কাগজে না লিখেই, ”অঞ্জন বিশ্বাস, কেমন? তবু তো দশজন হল।” বলতে বলতে ছুটে টেন্টের মধ্যে ঢুকল।
ইউনাইটেড ১৫৭ রান তুলল চার উইকেটে। অনাদি প্রথম আধ ঘণ্টার মধ্যেই তিনটি ক্যাচ ফেলল। প্রথমটি স্লিপে, দ্বিতীয়টি মিড—অনে, তৃতীয়টি ডিপ—স্কোয়্যার লেগে। পাড়ায় রাস্তায় ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলার বেশি অনাদি আর খেলেনি। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কখনো ভাবেনি সে। তার দলের প্রত্যেকের মুখের বিস্ময়, অসহায় বিরক্তিতে রূপান্তরিত হল। মাঠের বাইরে দুটো চ্যাংড়া ছেলে কিছুক্ষণ ওর পিছনে লেগে অবশেষে একঘেঁয়ে বোধ করে চলে গেল।
অনাদিকে কোথায় যে দাঁড় করাবে, ভেবে পাচ্ছে না অধিনায়ক। লং লেগ থেকে লং অন তারপর ডিপ একস্ট্রা কভার, অবশেষে ডিপ থার্ড—ম্যান। উবু হয়ে ভয়ে ভয়ে দু—হাতে থাবড়ে বল আটকাতে গিয়ে আটটা বাউন্ডারি দিল অনাদি। ওর কাছে বল গেলেই ব্যাটসম্যানরা নির্ভাবনায় রান নেয়। মাঠের বাইরে ইউনাইটেডের লোকেরা তখন হইচই হাসাহাসি করে। মাঠের মধ্যে একজন, ওভার শেষে অনাদিকে শুনিয়েই বলল, ”বকুদা আর লোক পেল না, একটা পাঁঠাও যে ওর থেকে ভাল ফিল্ডিং দেবে।” শুনে হাসি লুকোবার চেষ্টাও করল না বোলারের দিকের আম্পায়ার। একজন ব্যাটসম্যান খুবই সহানুভূতির সঙ্গে উইকেটকিপারকে বলল, ”এখন আর কিছু বলবেন না দাদা, তাহলে ঘাবড়ে যাবে।”
এরপর অনাদি ক্ষ্যাপার মতো ছোটাছুটি শুরু করল। বুক দিয়ে, হাঁটু দিয়ে, এমনকি ঝাঁপিয়ে মাথা দিয়েও বল আটকাল এবং সবাইকে তাজ্জব বানিয়ে রান আউটও করল প্রায় ত্রিশ গজ দৌড়ে এসে, কভার থেকে সোজা উইকেটে বল মেরে। তিন—চারজন ফিল্ডার ছুটে এসে ওর পিঠ চাপড়াল, আউট—হওয়া ব্যাটসম্যানটিও হেসে ‘গুড থ্রো’ বলে গেল। অনাদি অভিভূত হয়ে বোকার মতো হাসল মাত্র এবং পরের ওভারেই অতি সহজ ক্যাচটি ফেলে দিল। মাঠের নয়জনের কণ্ঠ থেকে চাপা একটা আর্তনাদ উঠেই সেটা ক্রুদ্ধ গর্জনে পরিণত হল। ওভার শেষে অধিনায়ক অনাদির কাছ এসে উঁচু গলায় বলল, ”দেখি তো, আপনার আঙুলে বোধহয় লেগেছে।” ওর হাতটা তুলে আঙুল পরীক্ষা করতে করতে তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”আমরা ন—জনেই খেলব, আপনি দয়া করে বেরিয়ে যান।”
মাথা নামিয়ে মুখটা কালো করে অনাদি মাঠ থেকে বেরিয়ে এল, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে। মুখ টিপে কেউ কেউ হাসল, বকুদা শুকনো—স্বরে বলল, ”চলে এলেন কেন?”
অনাদি বলল, ”আঙুলে লেগেছে, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”
বকুদা মুখ ফিরিয়ে মাঠের দিকে তাকাল। অনাদি ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে গেল। গেটের বাইরে রান আউট হওয়া ব্যাটসম্যানটি এক সুরূপা তরুণীর সঙ্গে হাসাহাসি করছে। একটি বছরদশেকের ছেলে ওর ব্যাটটি নিয়ে ছায়া—ড্রাইভ করায় ব্যস্ত। অনাদি আর টেন্টের দিকে গেল না।
লাঞ্চের পর ইছাপুর ব্যাট করতে নামল। চটপট ১৯ রানে তিনটে উইকেট পড়ে যাবার পরই জেতবার আশা ছেড়ে, ড্র—এর জন্য খেলতে লাগল। চতুর্থ উইকেটের দুই ব্যাটসম্যান সওয়া ঘণ্টা কাটিয়ে ৪৩ রান তুলেছে। অনাদির নাম সবার শেষ দশ নম্বরে। ইতিমধ্যে ও ঠিক করে ফেলেছে, চলে যাবে ব্যাট না করেই। লাঞ্চের সময় দেখে রেখেছে একটা সোয়েটার, যার দাম অন্তত আশি—নব্বই টাকা। প্রাকৃতিক কাজের ছুতোয় টেন্টের মধ্যে বার দুয়েক ঘুরে এসে গাঁদা গাছের ধারে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে করতে অনাদি ভিতরে নজর রাখল। মাঠে তখন লড়াই জমতে শুরু করেছে। কাজ হাসিল করে এইবার পালাতে হবে।