”আপনার সঙ্গে কি শত্রুতা আছে যে জব্দে ফেললেন? বলুন বলুন কী করেছি?” লোকটি চিৎকারের বদলে আর্তনাদ করে উঠল, ”বিপদে পড়েই এসেছি, প্যাঁচ কষে যদি আরও টাকা আদায় করতে চান, করুন।” পাগলের মতো ব্যাগের চেন টানল সে পাঁচ টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরল।
”নিন, নিন, উদ্ধার করুন আমায়।” ঠোটের কোণে ফেনা জমেছে লোকটির। চোখে বেপরোয়া চাউনি।
”আরও চাই? লজ্জার কী, কত দিলে অসীমের পা ভালো হয়ে যাবে?” ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করল। নৃসিংহর হাতটা টেনে নিয়ে মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিতে গেল। ভাঙা ডালের মতো হাতটা ঝুলে পড়ল। নৃসিংহ নিজেকে টানতে টানতে রকে এনে বসাল। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে চশমার কিনারে পৌঁছে গেছে। উদাসীনরা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। মেয়েরা রেলিং—এ ঝুঁকে।
”বিশ্বাস করছেন না? নিজেই তো দেখলেন ও খোঁড়াচ্ছে। আপনার টাকা থেকে যেটুকু খরচ করে ফেলেছি, শোধ করে দোব, ঠিক দোব, এই কৃপাটুকু অন্তত করুন।”
নৃসিংহ দুই হাত জোড় করতেই কুড়ুলের মতো দশ টাকার নোট ধরা একটি হাত নেমে এল। অসহায়ভাবে সে চারপাশ, উপরে এবং সদর দরজায় দাঁড়ানো গীতার দিকে তাকাল। ঘাম গড়িয়ে নামছে কাচের উপর। মুখগুলো ক্রমশ আবছা হয়ে এল। কাচ ভেদ করে তাকাবার চেষ্টায় কুঁচকে গেল মুখের চামড়া, হাতদুটো ঝুলে পড়ল। মাথা নেড়ে নেড়ে সে বলল, ”আমি ধর্মপথে থাকতে চাই। জোচ্চচুরি কলঙ্ক আর এই বয়সে আমার মাথায় তুলে দেবেন না।”
”কিন্তু এখন আমি ওর বদলে কাকে পাব? সময়ই—বা কোথা। এইভাবে আমার টিমকে ডোবাবেন না। দয়া করুন। আপনি বললেই হবে।”
আর একজন বলল, ”ওকেই নিয়ে যান না। এমন থ্রু পাশ দেবে গোল অবধারিত।”
কয়েকটি শিশু হঠাৎ চেচিয়ে উঠল, ”গোল, গোল, গোল।”
নৃসিংহ আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বহু দূরের অস্পষ্ট ঢেউয়ের মতো হাজার হাজার চিৎকার মাথার মধ্যে উঠছে আর পড়ছে। মুখের কাছে মুখ এনে লোকটি কী সব বলছে। ঝাপসা কাচের মধ্য দিয়ে পুরনো বাসি লাগছে মুখটা গ্যালারি থেকে ধাপে ধাপে যেন নেমে এল। নৃসিংহ বুঝতে পাচ্ছে না মুখটা কী চায়। থুথু দেবে, জুতো ছুঁড়বে, ফালাফালা করে চিরবে?
অনেক খেলাই তো দেখিয়াছেন যৌবনে, বুড়ো বয়সে খেল আর নাই বা দেখালেন?
কেন দেখাব না? নৃসিংহ কথা বলার চেষ্টা করল। গলা বুজে গেছে। চেষ্টা করেও গীতার কাপড়ের রং ঠাওর করতে পারল না। লোকটা কী বলছে আর শোনা যাচ্ছে না। শুধু আবছা মুখ গ্যালারিতে। আমার থেকেও খোকার ভবিষ্যৎ বড়। ওকে পাঠাব না। থাকো সবাই দাঁড়িয়ে। দেখবে খোকা এসে জড়িয়ে ধরবে।
কে একজন বলল, ”ওকে বলে কিছু হবে না, মশাই, দেখছেন না স্যায়নার মতো কেমন বিড়বিড় করছে। ওর বৌকে বলুন না, ওই তো দাঁড়িয়ে।”
.
কতক্ষণ কেটে গেছে নৃসিংহ তা জানে না। বোধহীন জড়পদার্থের মতো রকে বসেছিল। হঠাৎ তার সাড় ফিরে এল।
”কে খোকা?” ধড়মড়িয়ে নৃসিংহ উঠে দাঁড়াল। মনে হল কে যেন বাবা বাবা বলে ডাকছে। রাস্তায় পথিকের আনাগোনা, শিশুরা খেলা করছে আর বাচ্চচু অবাক হয়ে তাকিয়ে।
”দাদাতো খেলতে চলে গেছে। ভাত খেয়ে অফিস যাবে না? মা ডাকছে।”
পরগাছা
শীতে কলকাতায় ক্রিকেট শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অনাদিও সাদা ট্রাউজার্স, সাদা শার্ট আর সাদা কেডস পরে হাতে কিট ব্যাগ ঝুলিয়ে ময়দানে এমাঠ ওমাঠ ঘুরে বেড়ায় আর সুযোগ পেলেই চুরি করে। ওর চাল—চলন বা কথায় কেউ সন্দেহ করে না। সহজভাবে খেলোয়াড় বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মেশে, টেন্টের মধ্যে ঢুকে যায়। যখন মাঠে খেলা চলে এবং দু—দলের লোকেরা মাঠের ধারে খাটানো সামিয়ানার নিচে অথবা টেন্টের মধ্যে যখন ঢিলেঢালা পাহারা, অনাদি তখন কাজ হাসিল করে। হাতঘড়ি, ফাউন্টেন পেন, মানিব্যাগ, শার্ট বা ট্রাউজার্স, দামি ব্যাট, জুতো যা পায় হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে।
সেদিন অনাদি ব্যাগ হাতে একটু ব্যস্ততার সঙ্গে মালিকে জিগ্যেস করল, ”এটা কোন ক্লাবের মাঠ?”
”ইউনাইটেড ক্লাবের।”
”এ মাঠে আজ হাতিবাগান স্পোরটিংসের খেলা না?”
মালি ঘাবড়ে গেল, তারপর বিরক্ত হয়ে বলল, ”কি জানি, বাবুদের জিজ্ঞাসা করুন।” চুনগোলা বালতি নিয়ে মালি মাঠের দিকে চলে গেল। অনাদি লক্ষ্য করল টেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে ধুতির মধ্যে শার্ট গোঁজা, টাকমাথা এক মাঝবয়সি লোক খুবই উৎকণ্ঠিত হয়ে এধার ওধার তাকাচ্ছে। টেন্টের মধ্যে বুট পরে সিমেন্টের মেঝের উপর চলাফেরার শব্দ হচেছ খড়মড় খড়মড়। ড্রেস—করা একজন ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে টাকমাথাকে কী যেন বলতেই লোকটি রেগে উঠে চেঁচিয়ে বলল, ”আসবে কী আসবে না, সেটা ঠিক করে বললেই তো পারত। এখুনি তো টিমের নাম সাবমিট করতে হবে।”
টেন্ট এবং তার সংলগ্ন কাঠাদুয়েক জমি নিচু ফেন্সিং—এ ঘেরা। তার মধ্যে রয়েছে ঘাসে—ঢাকা একফালি জমি। কিছু গাঁদাফুলের গাছ। দুটো বেঞ্চ। টিউবওয়েল। অনাদি এগিয়ে গেল টাকমাথা লোকটির দিকে।
”আচ্ছা, আজ কি এখানে হাতিবাগানের খেলা আছে?”
”হাতিবাগান!” লোকটি অবাক হয়ে গেল। ‘ও নামের কোন ক্লাব খেলে নাকি?”
”তাতো জানি না।” আমতা আমতা করে অনাদি বলল, ”আমার এক বন্ধু বলেছিল কিন্তু খেলাটা যে কোন মাঠে সেটাই ভুলে গেছি। লিগের নয়, এমনি ফ্রেন্ডলি খেলা।”