”এর আগেও তো এমন কত লেগেছে, আবার লাফালাফিও করেছিস।” গীতা লঘুস্বরে বলল, ”তোর মতো সহ্যশক্তি আমি বাপু, কারুর দেখিনি। আর ফোলাটোলাও তো দেখছি না।”
অসীমের মুখ থেকে এক পরত রুক্ষতা মুছে গিয়ে তরলতা ভেসে উঠল। জোর পায়ে কয়েকবার লাফাল, কাল্পনিক বলে শট করল, তারপর বলল, ”ফোলা আছে তো, সাবধান না হলে জন্মের মতন খতম হয়ে যাব।”
নৃসিংহ পান খাচ্ছে, হাতে সিগারেটের নতুন প্যাকেট। খাটে বসে বলল, ”মিলিটারি টিমগুলোর কাছে কি কম মার খেয়েছি।” লুঙ্গিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে সে মারের দাগ খুঁজতে শুরু করল। তারপর অপ্রতিভ মুখে গীতাকে বলল, ”দই ছাড়া কিছু পেলাম না।”
”খাটটা পেতে দাও তো, মা, শোব।” অসীম উঠে দাঁড়াল।
গীতা দালানে ক্যাম্প খাট পাতছে সেই সময় নৃসিংহ বলল, ”তোকে নেবার জন্য একজন এসেছিল।”
”জানি জানি।”
নৃসিংহ ওকে সাহায্যের জন্য কাঁধ ধরতে হাত বাড়ায়।
”ঠিক আছে, এমন কিছু লাগেনি।”
হাতটাকে অগ্রাহ্য করে অসীম দালানে গিয়ে ক্যাম্প খাটে বসল। নৃসিংহ সিগারেট ধরিয়ে তারপর কয়েকটা টান দিল। শুনতে পাচ্ছে অসীমের দই খাওয়ার শব্দ। গলা চড়িয়ে সে বলল, ”কী দাম হয়েছে জিনিসের, দই দশ টাকা। আমরা আট আনা সেরের রুই দেখেছি, টাকায় চার সের দুধ। খাবে কি, খেলবেই বা কোত্থেকে।”
কোনো সাড়া না পেয়ে নৃসিংহ চুপ করে গেল। চাপাস্বরে অসীম বলল, ”বাবাকে ভ্যাজভ্যাজ করতে বারণ করো তো মা।”
”বলুক না, তুই অমন কচ্ছিস কেন। মিথ্যে তো আর নয়।”
”যাগগে”, নৃসিংহ আবার বলতে শুরু করল, ”শক্তিবাবু আজ দুখ্যু করছিল—মাইনের টাকায় দশদিনের বেশি চলে না, ছেলেটা এম এসসি পড়া ছেড়ে চাকরি নিয়েছে। পই—পই করে বারণ করলুম, যেভাবেই হোক তোর পড়ার খরচ চালাবোই, ছাড়িসনি পড়া, ছেলে শুনল না। মুখের ওপর বলল, ভাইবোনেদের ভাত থেকে বঞ্চিত করে বিদ্বান হয়ে আমার কাজ নেই।”
নৃসিংহ অপেক্ষা করল, দালান থেকে কোনো কৌতূহল আসে কিনা। তারপর সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ”বলতে বলতে শক্তিবাবুর হাউ—হাউ করে কী কান্না। একটা কথাই বারবার বলল, বাপের মুখ চেয়ে ভবিষ্যৎকে বিসর্জন দিল আমার ছেলে।”
গভীর রাত্রে গীতা বলল, ”ওসব গল্প খোকার সামনে কোর না। কষ্ট পায় শুনে। কাল যদি খেলতে না যায়, তাহলে কী হবে, টাকা তো নিয়ে রাখলে।”
”টাকা কি আমি নিজের জন্য নিয়েছি?”
”যদি ভালো না হয়? টাকা সকালেই ফেরত দিতে হবে তো?”
দুজন চুপ করে রইল। ভারী নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে দুজন কাঠ হয়ে যেতে লাগল। দুজনকে ক্রমশ ভয় ধরল। দুজন ধীরে ধীরে ফোঁপড়া হতে শুরু করল।
”বলেছিল, আবার লাগলে জন্মের মতো খতম হয়ে যাবে।”
”জানি, আমারও তাই হয়েছিল।”
”কাল টাকা দিয়ে দাও। যা খরচ হয়েছে পরে দিয়ে দেব।”
”কাল সকালেই ও ঠিক হয়ে যাবে।”
”ওর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। কাল টাকা ফেরত দিয়ে দাও। যা খরচ হয়েছে পরে দিয়ে দোব।”
”তুমি কি শুধু ওর মুখ চেয়েই কথা বলবে? কাল লোকটা এসে যখন আমায় অপমান করবে?”
”নয় সইলে।”
”তোমার গায়ে লাগবে না?”
উত্তরের আশায় সারারাত জেগে রইল নৃসিংহ।
.
পরদিন সকালে রাস্তায় ভিড় জমে গেল, লোকটি চিৎকার করছে—”ওসব চালাকি আমার জানা আছে। না যায় আপনার ছেলে, আমার টাকা ফেরত দিন, পুরো তিরিশ টাকা।”
ভিড়ে যারা নবাগত তাদের কৌতূহল মেটাতে লোকটি বৃত্তান্ত বর্ণনার আগে ভূমিকা শুরু করল। ”মশাই! নামকরা প্লেয়ার ছিল, কত ভক্তি শ্রদ্ধা করতুম আর সেই মানুষের কি অধঃপতন দেখুন—”
ঘরে নৃসিংহ মাথা নামিয়ে বসে, বাইরে থেকে লোকটির গলা ভেসে আসছে। ঘরে কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। উপর তলার লোকেরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় প্রাণপণে এ ঘরের দিকে না তাকিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বাচ্চচু বাইরে উঁকি দেবার চেষ্টা করছিল, নন্দু কান ধরে বসিয়ে দেয়।
”টাকা নিয়েছিলে কেন? কে নিতে বলেছে?” ঠক ঠক করে অসীম কাঁপছে।
আস্তে আস্তে মাথা তুলে নৃসিংহ তাকাল গীতার দিকে। ‘এটা যৌথ দায়িত্ব, তোমার অংশ নেওয়া উচিত, তুমি কিছু বলো’—এই কথাগুলোই সে যথাসম্ভব চোখে ফুটিয়ে তুলল। দেওয়ালে গীতা স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। সরালো না।
‘এ সংসার কি একা আমারই। নিষ্ঠুর আমাকে হতেই হবে, তোমার ভাগ কি শুধু স্নেহের?’ এই অভিযোগ তার চাহনিতে ফুটে উঠল। গীতা শোনার চেষ্টা করল না।
”তুমি ফুটবল খেলেছ না ঘোড়ার ডিম খেলেছ। গালাগালি দিক, থুথু দিক, জুতো পেটা করুক। আমি যাব না, কিছুতেই যাব না।”
দুহাতে মুখ ঢেকে অসীম নুয়ে পড়ল। বাইরে থেকে চিৎকার করে লোকটি অসীমকে ডাকছে। ঘরে সকলেই শুনতে পেল তবু বাচ্চচু বলল, ‘দাদাকে ডাকছে।” নন্দু ধমকাল ওকে। নীলু ফিসফিসিয়ে বলল, ”তোর সবতাতেই ওস্তাদি!”
উঠে দাঁড়াল নৃসিংহ। সব কথা চোখ ঝাপটা দিয়ে তার মুখে এসে পড়ল।
”কোথায় যাচ্ছ?” গীতার কাঁপাস্বরে চমকে উঠল অন্যরা।
”বাবা! যেও না।” নন্দু হাত ধরল নৃসিংহর। ”যে কটা কম পড়েছে আমি দিচ্ছি, আমার জমানো আছে।”
‘না’, মাত্র একটি শব্দ মহীরুহ পতনের মতো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।
বাচ্চচু অনিশ্চিতভাবে নীলুর কাছে জানতে চাইল, ”লোকটি কি বাবাকে মারবে?”
নৃসিংহকে দেখামাত্রই রাস্তাটা চুপ করে গেল। অলসভাবে সে দুধারে তাকাল। পরিচিতরা তাকে লজ্জা থেকে রেহাই দিতে ঔদাসীন্য দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বারান্দায় মেয়েরা এক পা পেছিয়ে গেল। শিশুরা এগিয়ে এল কৌতূহলে, পথিকেরা কিছু একটা ঘটবে বলে মন্থর হতে লাগল।