”জানি না, ইতিমধ্যে খোকা অ্যাডভান্স নিয়ে ফেলেছে কিনা।” নৃসিংহ চিন্তান্বিত মুখে লোকটিকে বলল।
”তাহলে ফেরত দিয়ে দিক, আমি তিরিশ টাকা দিয়ে যাচ্ছি। বলে দিক পায়ে চোট লেগেছে। এর ওপর তো আর কথাই নেই।”
লোকটি সড়াৎ করে চেন টেনে ব্যাগ খুলল। তিনটে দশ টাকার মোট নৃসিংহের দিকে এগিয়ে ধরতেই গীতা চাপা গলায় বলল, ”খোকার হাতে দিলেই ভালো হয়।”
”তাতে কি হয়েছে। বাবা মা কি পর?”
লোকটি যে দ্রুত টাকা ধরিয়ে দিতে চায়, নৃসিংহের হাতে গুঁজে দেওয়ার ব্যস্ততার মধ্যে গীতা টের পেল।
”তা ছাড়া কার হাতে দিচ্ছি সেটাও তো দেখতে হবে বৌদি! দাদাদের কাছে শুনেছি, গোল করে তারপর রেফারিকে জানিয়ে দিলেন হাতে ঠেলে গোল করেছি। সোজা ব্যাপার নয়, মহমেডানের সঙ্গে খেলা ছিল। হাফটাইমে সাপোর্টাররা সব গ্যালারি থেকে নেমে এল ওঁকে মারবার জন্য। জুতো ছুঁড়ছে ঢিল মারছে। তখন উনি বললেন, ধৈর্য হারাচ্ছেন কেন?—হ্যাঁ দাদা, বলুন না কি বলেছিলেন?”
”থাক থাক ওসব কথা।” নৃসিংহের গলা ভারী হয়ে এল। চশমাটা ঘামে নেমে এসেছে। হাতে নিয়ে বাচ্চচুর জামায় ডাঁটিটা মুছতে মুছতে বলল, ”ঠকিয়ে জিতে দুটো পয়েন্ট পাওয়া যায় কিন্তু আনন্দ?”
”শুনলেন তো, বৌদি, শুনলেন, এই লোকের হাতে তিরিশ কেন তিন কোটি টাকাও আমি তুলে দিতে পারি। এর ওপর আর কোনো কথা চলতে পারে না।”
লোকটি খুব হাসতে থাকল। নৃসিংহ দেখল গীতা একদৃষ্টে বিহ্বল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে।
”আমি তো ঠিক জানি না খোকা কত টাকা নেয়, সেদিন তো কাকে যেন বলছিল ওর রেট এখন পঞ্চাশ।”
”দোব দোব। আমার কাছে আর টাকা নেই, বিশ্বাস করুন, পঞ্চাশই দোব।”
”চা হচ্ছে খেয়ে যাবেন।” দরজার বাইরে নন্দুকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে দেখে গীতা বলল।
”না না, আমাকে এখুনি ট্রেন ধরতে হবে।” ঘড়ি দেখতে উঠে দাঁড়াল। ”কাল সকালে ঠিক নটায় আসব। ওকে রেডি হয়ে থাকতে বলবেন।”
লোকটি চলে যাবার পর নোটগুলো গীতার হাতে দেবার সময় নৃসিংহ বুঝতে পারল, কিছু একটা হচ্ছে তার দেহে—মনে। বহুদিন এমন হয়নি। আনন্দ সহকারে সে বলল, ”ওদের খেতে দাও।”
নীলু বাচ্চচুর খাওয়া দেখতে দেখতে নৃসিংহ বলল, ”শুকনো রুটি খেতে ওদের ভালো লাগছে না, একটু বোঁদে আনলে কেমন হয়?”
”না না, ওর থেকে এক পয়সাও নয়।” গীতার স্বরে দুজোড়া চোখের উত্তেজনা দপ করে নিভে গেল।
”নীলু কাল সকালেই রেশন দোকানে যাবে। না হলে বাবা দাদা কেউ ভাত খেয়ে বেরোতে পারবে না।”
”মা জানো”, গল্পের বই থেকে মুখ তুলে নন্দু বলল, ”দীপ্তির কাকা আজ সাড়ে তিন টাকা কিলোর চাল কিনেছে।”
”ওদের কথা বাদ দে।”
রাত হয়ে গেছে। অসীম এখনও ফেরেনি। নৃসিংহ রাস্তায় পায়চারি করে ফিরে আসতেই গীতা বলল, ”দূরে গেলে এই রকম দেরি তো হয়ই। কোনোদিন কি লক্ষ্য করেছ? মুখ ফুটে একদিনও কি জিজ্ঞেস করেছ, কেমন খেলছিস?”
”কেন কেন, বলেছে নাকি কিছু?”
”বলবে আবার কেন, দেখে বুঝতে পারি না? নয় বাপের মতো ওর অত নামই হয়নি।”
নৃসিংহ বলল, ”ওর খাওয়ার দিকে একটু নজর দিতে হবে। ডিম দুধের ব্যবস্থা করতে হবে।”
”যাক খুব দরদ দেখানো হচ্ছে, দেখো ও তোমার থেকেও ভালো খেলবেখন।”
শুনে নৃসিংহের শরীর চুইয়ে সুখ নামতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সে আনমনা হয়ে গেল।
অবশেষে অসীম ফিরল। ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, নন্দুও। নৃসিংহ ওর চলন দেখে এগিয়ে এসে হাত ধরল।
”কোথায় লেগেছে?”
”আবার সেইখানটায়।” ডান ঊরুতে, হাতের ভর দিয়ে নিচু হয়ে অসীম খাটে বসল। প্যান্ট তুলে বাঁ পা ছড়িয়ে বড় করে বসল।
”চুন হলুদ গরম করো তো।” পায়ের গোছে হাত বুলিয়ে বলল, ”দুটো খাস্তা উইং ব্যাক দু—পাশে। হুড়হুড় করে ইনসাইড দুটো ঢুকে আসছে স্টপার কি করবে?”
”হেরে এসেছিস?”
”খেয়ে এসেছিস?”
”আর খাওয়া। টাকা পর্যন্ত দেয়নি। দুটো উল্লুক ব্যাক নিয়ে স্টপার কি করবে? মাইলখানেক প্রায় অন্ধকারে ছুটেছি।”
বুকে হাত বোলাচ্ছে অসীম। টেরিলিন শার্টের গলা দিয়ে বুকের লোম নৃসিংহের চোখে পড়তে তার মনে হল, পুরো দস্তুর পুরুষ হয়ে উঠেছে ছেলেটা।
”এখনও মিষ্টির দোকান খোলা আছে, আনব?”
”বাড়িতে কিছু নেই?”
”আমি তো জানি খেয়েই আসবি!”
নৃসিংহর হাতে টাকা দেবার সময় গীতা লক্ষ্য করল, অসীম দেখছে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ও জানে না এটা কীসের টাকা। এখন জানানো উচিত হবে কি। তাড়াতাড়ি সদরে গিয়ে নৃসিংহকে দাঁড় করাল।
”কাল তাহলে কী হবে?”
”এখন কিছু বোল না।”
কাগজ জ্বেলে গীতা চুন হলুদ গরম করে লাগিয়ে দিল।
”জিতলে ব্যাটারা মুরগির ঝোল খাওয়াবে বলেছিল। মুখটাকে বেঁকিয়ে অসীম হাঁ করে চিত হয়ে পড়ল। ঝুঁকে গীতা বলল, ”হ্যাঁরে, খুব বেশি লেগেছে কি? একটা লোক এসেছিল, পটাদা নাম বলল। কাল তারকেশ্বরের কাছে ওদের খেলা।”
”রাখো তোমার খেলা। এই পা এখন কি ভোগায় কে জানে?”
”পঞ্চাশ টাকা দেবে বলেছে”, গীতা আর একটু ঝুঁকল। অসীমের মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চামড়া রুক্ষ, গাল চোপসান, কানের পাশের হাড় উঁচু, বুক চ্যাপ্টা, কনুইয়ে শিরার জট। গীতার মনে হল এই বয়সে একটা ছেলের যেমন দেখতে হওয়া উচিত খোকা তা নয়। যেমন করে কথা বলা উচিত তা বলে না। গীতা দুঃখে ভরে উঠল।
অসীম পায়চারি শুরু করল। লাগছে বেশ। উবু হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ল নৃসিংহকে ঢুকতে দেখে।