”কীভাবে আটকাব? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করব না ঘরে এনে বসাব? এক কাপ চা—ও তো দিতে হবে।”
রেগে উঠল গীতা। সদরে এসে উঁকি দিয়ে দেখল। উঠোনের তারে ভিজে কাপড় মেলতে মেলতে নন্দু গুন গুন করছে। একটু পরেই নীলু বাচ্চচু ফিরল মাথা নাড়তে নাড়তে।
”পঞ্চাশ টাকা হাতে না নিয়ে খোকার যাওয়া উচিত হবে না। ফার্স্ট ডিভিসন প্লেয়ারকে একশো দিলে ওর তো কম করে পঞ্চাশ পাওয়া উচিত।” গীতা ঘরে ঢোকা মাত্র নৃসিংহ বলল।
”অত কি দেবে, নবদ্বীপে তো তিরিশ পেয়েছিল।”
”কত বড় একটা মাছ এনেছিল।” বাচ্চচু দ্রুত যোগ করল।
”বিপদে পড়ে এসেছে বলেছে যখন, পঞ্চাশ চাইলে তাই দেবে। ফার্স্ট ডিভিসনের যা সব প্লেয়ারের ছিরি, খোকা তাদের থেকে কিসে কম।” নৃসিংহ উঠে বসল। ”ওসব নামকাওয়াস্তেই ডিভিসনের প্লেয়ার, এই বয়সে আমি যা থ্রু দোব পারুক দেখি কেউ।”
”গৌতমের সঙ্গে পারবে?” বাচ্চচু ফিসফিসিয়ে নীলুর কাছে জানতে চাইল। আড়ে বাবাকে দেখে নিয়ে নীলু ঠোঁট ওল্টালো, ”দাদার সঙ্গেই পারবে না।” বাচ্চচু সায় দেবার মতো চোখ করল।
”আমরা শিখেছিলুম মুখে রক্ত তুলে। তখন তো পঁচিশ পঞ্চাশ হাজারের ব্যাপার ছিল না যে টাকার মুখ চেয়ে খেলব। ট্রামভাড়া পেলেই বর্তে যেতুম। তবুও তো খেলেছি।”
নৃসিংহ চিবুক তুলে এমনভাবে তাকাল যে ছাব্বিশ বছরের চেনা স্বামীকে গীতার মনে হল এই প্রথম দেখছে। নন্দু গল্পের বই নিয়ে বসেছে। গীতা বলল, ”দেখ না নন্দু, একটু ভালো চা পাওয়া যায় কিনা, ভদ্রলোক এলে দিতে হবে তো।”
”দীপ্তিদের বাড়ি থেকে?” চোখ না তুলেই নন্দু বলল। ”পারব না। কেরোসিন এনেছিলুম এখনও শোধ দেওয়া হয়নি। আমি আর কিছু চাইতে পারব না।”
”তা পারবে কেন, শুধু লোকের বাড়ি খেয়ে আসতে পারবে। সংসারে উপকার হয় যে কাজে তা করবে কেন?”
”করি না? ঝিয়ের মতো শুধু তো খেটেই চলেছি। ভালো একটা কাপড়ও জোটে না। একটা সিনেমা পর্যন্ত দেখতে পাই না, শুধু গালাগাল আর মার! এবার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।”
নন্দু গলা কাঁপিয়ে তারপর দপদপিয়ে বেরিয়ে গেল। বিবৃত করা ছাড়া নৃসিংহ মুখটাকে নিয়ে আর কিছু করতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”রকে গিয়ে বসছি।”
থম হয়ে বসে রইল গীতা। নীলু কিছু বলতে যাচ্ছিল, ধমকে উঠল, ”তোদের কি পড়াশোনা নেই?”
রকের একপ্রান্তে কয়েকজন যুবক তাস খেলছে। কর্পোরেশনের আলোটা দিনেও জ্বলে। বালবটা কয়েক হপ্তা অন্তর কেটে যায়। এবার কবে কাটবে তাই নিয়ে নৃসিংহ ও পরিমলবাবু কথা শুরু করে গাফিলতি, ঘুষ, ভেজাল ইত্যাদি বহুবিধ উদাহরণ দিয়ে মানুষ কী পরিমাণ চরিত্রভ্রষ্ট হয়েছে প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে উঠল। নৃসিংহ বলল, ”টাকা না দিলে আজকাল কোনো কাজই করানো যায় না। খেলবে, তাও টাকার জন্য, আমাদের সময় ছিল ইজ্জত। ট্রফি নোব, ক্লাবের নাম বাড়াব, তার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারতুম আর আজকালকার ছেলেরা?”
রকের প্রান্ত থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে কে বলল, ”রামায়ণ পাঠ শুরু হল।”
”মনে আছে, পরিমলবাবু, কে ও এস বি—র সঙ্গে সেমিফাইনাল?”
”দু দিন ড্র হয়েছিল।”
”লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, হাঁটতে পর্যন্ত পারছি না।” নৃসিংহ উত্তেজনায় সিধে হয়ে গেল। গলা কাঁপছে।
পরিমলবাবু একটা বিড়ি এগিয়ে দিল। নৃসিংহ ভ্রূক্ষেপ করল না।
”হারুবাবু এসে দুটো হাত চেপে ধরে বললেন, ক্লাবকে ফাইনালে তুলে দে। এত বড় সম্মান আগে ক্লাবের সামনে কখনো আসেনি। হাতছাড়া হয়ে যাবে, নৃসিংহ, তুই থাকতে? কথাগুলো বুকে গেঁথে গেল। বুঝলেন, পরিমলবাবু, তখন মনের মধ্যে যা হল কী বলব। অত বড় ক্লাব যেন আমার মুখ চেয়ে রয়েছে।”
”সেই খেলাই তো আপনার কাল হল। পা—টা চিরকালের মতো গেল। যাই বলুন, আপনার নামা উচিত হয়নি।”
হা হা করে নৃসিংহ হেসে উঠল।
”ফাইনালে ক্লাব উঠল। আমার থ্রু থেকেই নেট করল বিশু সামন্ত। এখনও দেখা হলে বিশু বলে—” নৃসিংহ লোকটিকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ”আপনি কি অসীমকে খুঁজছেন?”
ঘাড় নেড়ে লোকটি কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে বিস্ময় দ্বারা আবিষ্ট হবার পর বলল, ”ইস! একি চেহারা হয়েছে দাদা। চিনতেই যে পারা যায় না। সেই ছোটবেলায় কবে দেখেছি আর এই। ওই গোরা টিমগুলোর সঙ্গে আপনার সেইসব খেলা! এখন তো মাঠেই যেতে ইচ্ছে করে না।”
চশমাটা উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে নৃসিংহ বলল, ”থাক থাক ওসব কথা ভাই, আর তুলে লাভ কি? দিন তো কারু জন্য বসে থাকে না।”
ঝরঝর করে হেসে নৃসিংহ লোকটিকে নিয়ে যেতেই তাসের দলের একজন বলল, ”পরিমলবাবু, গপ্পো করার যদি দরকার হয় অন্য কোথাও গিয়ে করুন। পাঁচ লক্ষবার ওর গপ্পো শুনেছি, আমাদের বাবারাও শুনেছে। আর পারা যায় না।”
”না না, তোমরা ঠিক জান না, সত্যি কথাই বলে লোকটা। আমরা যে দেখেছি ওর খেলা।” পরিমলবাবু দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।
ঘোমটা দিয়ে গীতা খাটের ধারে দাঁড়াল। নৃসিংহ ওর দিকে তাকিয়ে লোকটিকে বলল, ”যাবে কিনা তাতো বলতে পারব না। বলছিল না গো কাল কোথায় যেন যেতে পারে?”
গীতা কিছু একটা বলল অস্ফুটে। লোকটি দু—জনের দিকে তাকিয়ে কাতর হয়ে পড়ল।
”গ্রামের টিম কিছুই খেলতে পারে না। একজন অন্তত ডিফেন্সটা যদি সামলে না রাখে তাহলে একেবারে ডুবে যাব। ওরা পাঁচজনকে হায়ার করে নিয়ে যাচ্ছে কলকাতা থেকে।”