তখন আমি জানলাম, ও এবার মারা যাবে।
গ্যালারির মুখগুলি
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দুজন ইতস্তত করল। উপুড় হয়ে, মাথাটা হাঁড়িকাঠের মতো দুই বাহুর মধ্যে রেখে গীতা মেঝেয় শুয়ে, সন্ধ্যা থেকেই এইভাবে শুয়ে থাকে, কিছু করার না থাকলে। ওরা দুজন তাক থেকে পড়ার বই নিয়ে, ঘরের কোণে খাট আর দেয়ালের অল্প জায়গাটুকুতে বসল, খাটটা ইট দিয়ে উঁচু করা, সংসারের তিন—চতুর্থাংশ বস্তু রাখা, ঘরের বাইরে দালানটায় রান্না হয়। রাত্রে ক্যাম্প খাট পেতে অসীম শোয়।
বিড়বিড় করে ওরা পড়ছে। গীতা ওদের দিকে না তাকিয়েই বলল, ”সারাদিনই তো শুধু খেলা, হাত—পায়ের নোংরা কাদা ধোবে কে?”
ওরা দুজন গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, গীতা আবার বলল, ”নন্দুকে বলো বাড়ি ফিরতে, দীপ্তিদের বাড়ি গেছে।”
নীলু আর বাচ্চচু রাস্তার টিউবওয়েলে পরিষ্কার হয়ে, পেট ভরে জল খেল।
”হারুদাদের রকে ক্যারাম খেলছে, যাবি?”
”দেরি হয়ে যাবে, দিদিকে ডাকতে হবে না?”
নীলু এক বছরের বড়, স্বরে তা ফুটে উঠল।
দীপ্তিদের সদরে দাঁড়িয়ে নীলু চিৎকার করে ডাকতেই ছাদ থেকে ঝুঁকে নন্দু বলল, ”একটু পরে যাচ্ছি বল গিয়ে।” নীলু ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করল, অন্ধকারে দেখতে পেল না, ফেরার সময় হঠাৎ বাচ্চচু হেঁচকি তুলে কুঁজো হয়ে বমি করল। শুধু টিউবওয়েলের জলটুকু বেরোল। কাতর হয়ে বারবার সে বলল, ”মাকে বলবি না তো?”
ঘরে এসে ওরা এবার চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করল। গীতা একইভাবে শুয়ে। সাতদিন ধরে একই পদ্য চিৎকার করে পড়ে চলেছে বুঝেও সে চুপ রইল।
তখনই নন্দু ফিরল।
”ও বাড়িতে এতক্ষণ পর্যন্ত থাকার কি আছে? ডাকলে গ্রাহ্য হয় না, সঙ্গে সঙ্গে আসতে পার না?”
”আসছিলুম তো? বুড়িদির শ্বশুরবাড়ি থেকে কাঁঠাল পাঠিয়েছে; জেঠিমা বলল, অত বড় কাঁঠাল কে খাবে।”
পড়া বন্ধ করে নীলু বাচ্চচু তাকাল। গীতা উদ্যত হাতটা নামিয়ে নিয়ে বলল, ”খেয়ে এসেছিস?”
”গোটাটা খেলি?” নীলু বিশ্বাস করতে পারছে না।
বাচ্চচু বলল, ”দিদির পেট খারাপ হবে, না মা?”
গম্ভীর হয়ে নন্দু শাড়ি বদলাতে লাগল। পড়া ভুলে ওরা তাকিয়ে। গীতা ক্লান্তস্বরে বলল, ”কাপড়গুলো সকাল থেকে সেদ্ধ হয়ে পড়ে আছে, কাচবি কখন?”
”চৌবাচ্চচায় কি জল আছে? ওপরের ওরা তো বিকেলে হুড় হুড় করে জল ঢেলে গা ধুল।”
”না থাকে, নীলু টিউকল থেকে এনে দেবে।”
সঙ্গে সঙ্গে নীলু দাঁড়িয়ে পড়ল। বাচ্চচু বলল, ”আমি কল টিপব।”
গীতা দুই বাহুর হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে আবার শুয়ে রইল।
নিঃসাড়ে ঘরে ঢুকে নৃসিংহ জামা খুলছে টের পেয়েই গীতা উঠে বসল। তাকাচ্ছে না নৃসিংহ তার দিকে। চশমাটা ঘামে পিছলে নেমে এসেছে অনেকখানি। লুঙ্গি পরে চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে তুলে দিল।
”কাল রেশন আসবে কি?”
গামছা নিয়ে নৃসিংহ সাবানের বাক্সটা খুলে দেখার ছলে গীতার দিকে তাকিয়েই বেরিয়ে গেল দ্রুত। নন্দুর কাপড়কাচার ধপধপ শব্দ আসছে। গীতা বসে থাকল দেয়ালে ঠেস দিয়ে। নীলু চেঁচাচ্ছে, ”দিদি! বালতি দে, বাবা টিউকলে চান করবে।”
চোখ বুজে গীতা বসে আছে। সদরে কড়া নেড়ে কে বলল, ”অসীম ফিরেছে?”
”না”, নন্দু চেঁচিয়ে বলল।
”ফিরলে বলবেন, পটাদা খোঁজ করছিল, যেন বাড়ি থাকে। আমি আবার আসব।”
গীতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বছর চল্লিশের কালো, বেঁটে খাটো একটা লোক। হাতে ফোলিও ব্যাগ। পাঞ্জাবির বুক পকেটে ঝুলে রয়েছে চশমার একটা ডাটি। গলায় প্রচুর চর্বি—তার মধ্যে বসে আছে পাতলা সোনার চেন।
”অসীমকে খুঁজছি।”
”আমি অসীমের মা।” সন্তর্পণে গীতা বলল। লোকটা তখুনি দোকানদারের মতো নমস্কার করে বলল, ”আগে একবার ঘুরে গেছি, বৌদি। আমাদের গ্রামে কাল ফাইনাল খেলা, আমার টিম উঠেছে।” লোকটির মুখ সুখে ভরে উঠল। তারপরই অসহায় কণ্ঠে বলল, ”আমার স্টপার ছেলেটার মা আজ মারা গেছে।”
বলে তাকিয়েই রইল গীতার দিকে। অস্বস্তি বোধ করল গীতা। ভেবে পেল না কি বলা উচিত।
”অসীমই আমায় উদ্ধার করতে পারে।” লোকটা হাঁফ ছেড়ে উঠল।
”ও তো হাবড়া না কোথায় খেলতে গেছে, আসার তো কিছু ঠিক নেই।”
”তাইতো!” লোকটি মুষড়ে পড়ল। ”হঠাৎ এমন বিপদেই পড়ে গেলুম, মৃত্যুর ওপর তো হাত নেই কারু। গেছলুম ফাস্ট ডিভিসন প্লেয়ারের কাছে। একশো টাকা আগাম দোব বলে কবুল করলুম। বলল, আজ সকালেই আর এক জায়গা থেকে টাকা খেয়ে বসে আছে। না গেলে তারা পিঠের চামড়া তুলে নেবে।”
লোকটা জোরে কথা বলে। তড়বড়িয়ে বলে, বেশি বলে। গীতা অভ্যস্ত নয় এইসব কথাবার্তায়। চুপ করে রইল।
”আমি বরং একটু ঘুরে আসছি। দাদা কোথায়?”
”উনি চান করছেন।”
”আচ্ছা আচ্ছা, অসীমকে আমার হয়ে একটু বলবেন। বড্ড বিপদে পড়ে গেছি। মৃত্যুর ওপর তো আর হাত নেই।”
নৃসিংহ ফেরা মাত্র গীতা কথাগুলো তাকে জানাল।
”বসতে বললে না কেন? আজই তাহলে খোকা কিছু টাকা পেয়ে যেত। ঘুরে আসছি মানে ততক্ষণ আর কাউকে ধরতে গেল। পেয়ে গেলে আর আসবে না।”
হতাশায় নৃসিংহ খাটে গা এলিয়ে দিল। গীতা ব্যস্ত হয়ে নীলুকে বলল, ”দেখ তো, লোকটা বেশি দূর হয়তো যায়নি। দেখলে ডেকে নিয়ে আসবি।”
নীলুর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চচুও ছুটে বেরিয়ে গেল। বিরক্তস্বরে নৃসিংহ বলল, ”বুদ্ধি করে আটকে রাখবে তো।”