”প্রত্যেকটা ম্যাচই আমরা খেলে জিতেছি, ক্লিনলি অ্যান্ড অনেস্টলি।” রতন সরকারও গলা চড়াল।
”হ্যাঁ, ঘুষ দিয়ে।”
”মুখ সামলে বিজন! তোর কোচিংয়ের কেরামতিতে দু—দুটো টিম ফার্স্ট ডিভিশান থেকে নেমেছে; কোথাও পাত্তা না পেয়ে তাই সেকেন্ড ডিভিশানের টিম ধরেছিস। এখন নিজের মুখ রক্ষার জন্যে অন্যের গায়ে কাদা না ছিটোলে বাঁচবি কী করে, বল!”
বিজন দত্তকে দেখে আমার মনে হল এইবার ও রতন সরকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মুখ সাদা হয়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে। এই উত্তেজনা ওর অসুস্থতার পক্ষে ক্ষতিকর। এইবার আমি ওর হাত চেপে ধরলাম। ঝটকা দিয়ে আমার হাত ছুঁড়ে ফেলে দিল।
রতন সরকার তখন অতিদ্রুত গেট অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে দেখে হাঁফ ছেড়ে বললাম, ”চলুন, এইবার খেলা শুরু হবে।”
”না, দেখতে হয় আপনি যান। আমি ফিরে যাব এখন।” একটু আগের উত্তেজিত সেই উচ্চস্বর অবসাদে স্তিমিত। চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় হল। অদ্ভুত এক শূন্যতা ভেসে উঠেছে দুই চোখে। চতুর্দিকের জনতা ও কোলাহল ওকে যেন স্পর্শ করছে না।
ওকে সাইকেল—রিকশায় তুলে স্যানাটোরিয়ামে ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করলাম, ”ডাক্তারকে বলে এসেছেন তো?”
শিথিলভাবে পিছনে হেলান দিয়ে বিজন দত্ত মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বলল, ”ডাক্তারবাবু রাজি হয়নি। বলেছিল, যদি প্লুরুসি বাধাতে চান তাহলে যেতে পারেন। আমি লুকিয়ে এসেছি। অনেকটা হাঁটতে হয়েছে।”
বলতে বলতে বিজন দত্ত কাশতে শুরু করল। কাশি থামার পর লক্ষ্য করলাম শ্বাস—প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। শরীরটা কুঁকড়ে, রিকশার হাতল চেপে ধরে ক্রমশ ওর মাথাটা বুকের কাছে নেমে আসতেই প্রাণপণে তুলে ফ্যাকাশে মুখে বলল, ”বয়সটা যদি আপনার মতো হত।” তারপর সারাপথে আর একটিও কথা বলেনি।
.
পরদিন গিয়ে শুনলাম, রাত্রি থেকেই ওর দেহতাপ একশোয়। কাশির ধমকে ঘরের বাকি তিনজনের ঘুম কয়েকবার ভেঙে গেছিল। ডাক্তারবাবু ক্রুদ্ধস্বরে জানিয়েছেন, প্লুরিসি হলে তিনি মোটেই অবাক হবেন না।
”ডাক্তারবাবুর কথা শুনলে ভালোই করতুম। এইসব রোগ নিয়ে খেলা করাটা উচিত হয়নি। রতনটাই হয়তো শেষপর্যন্ত জিতে যাবে, আমার বোকামির জন্য। জানেন, এই রকম মাথা গরম করার জন্যই আমার কিছু হল না।” বিজন দত্ত মাথাটা কাত করে বাইরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, ”দুটি টিম আমার জন্যই নেমে গেল এ কথাটা কিন্তু পুরো সত্যি নয়। একটা ছেলেও খেলতে জানে না, ফুটবল সেন্স নেই। আমি একা আর কতটা সামাল দিতে পারি!”
ডাঃ বসুরায়ের কাছে খোঁজ নিলাম। স্পুটাম পরীক্ষা করে পজিটিভ হয়েছে। বিজন দত্তর ক্ষিধে কমে গেছে, চোখদুটি ক্রমশ বসে যাচ্ছে, ওজন দ্রুত কমছে। ওর স্ত্রী এখন রোজ আসছে। বিষণ্ণমুখে বসে থাকে আর চাপাস্বরে মাঝেমাঝে বলে, ”তোমার সেদিন যাওয়া উচিত হয়নি। তুমি জানতে এতে তোমার ক্ষতি হবে।” ইতিপূর্বে বিজন দত্তর মুখে ‘এ.পি’, ‘পি.পি’, ‘রিফিল’, ‘পি.এ.এস’, ‘থোরা’ প্রভৃতি শব্দগুলি কখনো শুনিনি। এগুলির উল্লেখ না করে সে যেন তার রোগের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করত। কিন্তু এখন তার মুখে মাঝে মাঝে অসুখের কথা শুনতে পাই। কথা কম বলে। একদিন স্কুল যাবার পথে সকালে, বিধবা মহিলাটিকে দেখলাম, শুকনো মুখে হেঁটে চলেছে স্যানাটোরিয়ামের দিকে।
.
নানান দাবিতে তখন বাংলাদেশে শিক্ষক আন্দোলনের প্রস্তুতি চলেছে। আমিও সংগঠনের কাজে জড়িত। অবস্থান ধর্মঘট হবে রাজ্যপাল ভবনের সামনে। পরপর কয়দিন বিজন দত্তকে দেখতে যেতে পারিনি। একদিন গিয়ে দেখি ওকে অন্য একটি ঘরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখা করা নিষেধ। ডাঃ বসুরায় বললেন, ”উঁই আর গোয়িং টু কোল্যাপস দ্য আদার লাং।”
দিনচারেক পর আবার গেলাম, দুপুরে। এক মিনিটের জন্য দেখা করার অনুমতি পেলাম, কথা বলা বারণ। বিজন দত্ত চিত হয়ে একদৃষ্টে সিলিংয়ে তাকিয়ে। গালদুটি বসে গেছে। একদা যে বিপুল শক্তি এই দেহ ধারণ করত তার ধ্বংসাবশেষ মাত্র অবশিষ্ট।
”কী খবর!” ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বিজন দত্ত বলল।
”কথা বলবেন না।” নার্স ছোট্ট করে ধমক দিল। হাত তুলে ওকে ব্যস্ত না হবার ইঙ্গিত করে বিজন দত্ত আমাকে বলল, ”পুকুর ধারে ওরা রোজ খেলে?”
জানি না খেলে কিনা, তবু ওকে খুশি করার জন্য বললাম, ”রোজই খেলে।”
”ওদের মধ্যে একটা ছেলে আছে দেখবেন, দারুণ ফুটবল সেন্স।”
নার্স এবার আমায় বলল, ”আপনি বাইরে যান, নয়তো উনি কথা বলে যাবেন।”
আমি যাবার জন্য ঘুরছি, শুনলাম টেনে টেনে বলছে, ”ভেবেছি ছেলেটাকে তৈরি করব।”
স্টেশনের পথে হেঁটে যেতে যেতে, ওর কথাই ভাবলাম। চোখে বারবার ভেসে উঠল, একা ঘরে প্রাচীন ভগ্নস্তূপের মতো পড়ে থাকা দেহটিকে, শীর্ণ হাতটির ধীরগতি উত্তোলনভঙ্গি, নিশ্বাস নিতে নিতে দমবন্ধ করে কথা বলা। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ওর সেই বন্য প্রাণশক্তি যার ফলে ওকে দুর্ভেদ্য মনে হত, মৃত্যু সেখানে ফাটল ধরিয়েছে কিনা।
দিনপাঁচেক পর, বিকেলে, স্যানাটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছি। শরতের বিকেলের আকাশ ঘন নীল, বহুদূর পর্যন্ত তার উজ্জ্বলতা ব্যাপ্ত। নিকটের একটি বাড়ি থেকে কোমল নারীকণ্ঠের সংগীতের সুর ভেসে এল। মন্থরগতিতে মোড় ফিরলাম। এবার সোজা রাস্তা। স্যানাটোরিয়ামের গেট দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল গেট থেকে সেই বিধবা মহিলা বেরোচ্ছেন বিজন দত্তর ছেলের হাত ধরে, তাঁর পিছনে বিজন দত্তর স্ত্রী ক্লান্ত পায়ে আসছে।