”এই অসুখটা বাঁধালেন কী করে?”
”কী করে! ডাক্তার বলেছিল বেশি খাটুনির জন্যই নাকি। অথচ পঁচিশ বছর ধরেই আমি এইভাবে খেটে আসছি। তাতে কী বলল জানেন? আপনি তো আর আগের মতো ছোকরা নেই, বয়স যে বেড়েছে। ঠিক, কিন্তু আমি বুড়োও হইনি। হয়েছি কি?”
ওর দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে মনে হল, বিজন দত্ত নিজের চোখে বরাবরই তরুণ থেকে যাবে। বার্ধক্যকে স্বীকার করা ওর পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। ”মাসখানেক বড়জোর, তারপরই ফিরে গিয়ে আবার শুরু করব ছেলেদের নিয়ে। ফাস ডিভিশানে সামনের বার উঠতেই হবে। পরশুর কাগজে দেখলুম আমরা সাত গোল খেয়েছি।”
শেষ বাক্যটি বলার সময় মনে হল, ওর মুখটা যন্ত্রণায় কালো হয়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বলল, ”আজকালকার ফ্যাশান হয়েছে উইংব্যাক উঠে গিয়ে গোল দিয়ে আসবে। আমি কখনো ওদের তা করতে দিই না। উঠতে পারে ঠিকই কিন্তু পাল্টা অ্যাটাক হলেই বাবুরা আর চটপট নামতে পারে না। বোধহয় তাই করেই গোল খেয়েছে। আমি থাকলে এটা হত না। একবার চারটে ম্যাচ আমি বসিয়ে রেখেছিলুম আমার স্টপারকে, কথা শোনেনি বলে।”
.
পরদিন আমি খানিকটা উত্তেজিত হয়েই হাজির হলাম। বিজন দত্ত তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে। হ্যান্ডবিলটা ওর চোখের সামনে ধরে বললাম, ”এই দেখুন, প্রদীপ সঙ্ঘ পরশু রোববার এখানে এক্সিবিশন ম্যাচ খেলবে লোকাল ইলেভেনের সঙ্গে।”
ক্ষুধার্তের মতো কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে গোগ্রাসে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত পড়ে বিজন দত্ত বলল, ”আমি দেখতে যাব, মাঠটা কতদূরে? টিকিট ওখানে গিয়ে পাওয়া যাবে তো?”
”মাঠ প্রায় মাইলদেড়েক। কিন্তু অত দূর যাওয়া—আসার ধকল সহ্য করার মতো শরীর এখনো তো আপনার হয়নি!”
”আমার শরীরের ব্যাপার আমি বুঝব, তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।” রুক্ষস্বরে বিজন দত্ত বলল, ”রতন নিশ্চয়ই আসবে ওর টিমের সঙ্গে। সকলের সামনে অপমান করব।”
ঠিক সেই সময়ই বিধবা মহিলাটি ঘরে ঢুকল। আমার মুখে এসে যাওয়া কথাগুলিকে বহু কষ্টে চেপে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। স্যানাটোরিয়াম গেট থেকে বেরিয়েই দেখি ছেলেকে নিয়ে রতন দত্তর স্ত্রী আসছে। ওকে দেখে মনে মনে অদ্ভুত একটা উল্লাস বোধ করলাম। বাছাধন আজ মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখুক! স্টেশনে এসে দেখি অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে কলকাতার ট্রেনের জন্য। বিধবা মহিলাটি আমার একটু পরেই স্টেশনে পৌঁছল। মুখ বিবর্ণ এবং বিরক্তি মাখানো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে প্ল্যাটফর্ম—প্রান্তের বেঞ্চে গিয়ে বসল। উনি বিজন দত্তর কে হন, সেটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। তবে অনাত্মীয় যে, এটা বোঝা যায়। এই মহিলা এবং বিজন দত্তর স্ত্রী কখনো একসঙ্গে আসেন না।
.
রবিবার ট্রেন থেকে নেমে সোজা মাঠে চলে এলাম। আসতাম না। প্রদীপ সঙ্ঘ এমন কিছু টিম নয়, খেলা দেখার জন্য ছুটির দিন কলকাতা থেকে ছুটে আসব। বস্তুত ফার্স্ট ডিভিশনে খেললেও কী ওদের জার্সির রঙ জানি না। কিন্তু মনে হল, বিজন দত্ত খেলা দেখতে আসবেই আর রতন সরকারের সঙ্গে কিছু একটা বাধাবে। দুজনকে মুখোমুখি দেখার লোভেই বোধহয় এসেছি।
পৌঁছে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। বাস, রিকশা, গোরুর গাড়ি, সাইকেলে দূর গ্রাম থেকেও লোক এসেছে। মাঠটা টিম দিয়ে ঘেরা হয়েছে। প্রদীপ সঙ্ঘ উঠেছে মাঠের কাছেই এক ব্যবসায়ীর বাড়ি। সেখান থেকে হেঁটে আসবে। তারা যে গেট দিয়ে মাঠে ঢুকবে সেখানে অল্পবয়সিদের ভিড়। হঠাৎ চোখে পড়ল বিজন দত্ত সেই গেটের কিছু দূরে অধীরভাবে ঘোরাফেরা করছে। আমি কাছে গেলাম না। স্কুলের দুটি ছাত্র সিগারেট লুকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসতেই ভিড় থেকে দূরে সরে গেলাম।
প্রদীপ সঙ্ঘের খেলোয়াড়রা আসতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল গেটের কাছে। দূর থেকেই দেখলাম, বেঁটে, কালো, কুতকুতে ধূর্ত চোখ, মোটাসোটা একটি লোককে লক্ষ্য করে বিজন দত্ত এগোচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি ওর কাছাকাছি হবার চেষ্টা করলাম। ওদের প্রাথমিক কথা শুনতে পেলাম না। শুধু দেখলাম বিজন দত্ত অচঞ্চল শান্তভঙ্গিতে কী বলতেই, লোকটার মুখে অস্বস্তি ফুটল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে পাশ কাটাবার চেষ্টা করছে। বিজন দত্ত পথরোধ করে দাঁড়াল। লোকটি বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েও ঘনিষ্ঠস্বরে বলল, ”তোর অসুখ হয়েছে শুনেছিলুম, এখন কেমন আছিস?”
”ভালোই। তোকে দেখে আরও ভালো লাগছে।” বিজন দত্ত চারপাশের উদগ্রীব মুখগুলোর উপর মৃদু হেসে চোখ বোলাল। ”তারপর, রতন এবারও কি টাকা দিয়ে ম্যাচ কিনে ফাস ডিভিশানে চ্যাম্পিয়ান হবার মতলব করেছিস নাকি?”
”তার মানে?” রতন সরকার তেরিয়া মেজাজে বললেও ওর চোখে ভীত ভাব দেখলাম।
”সেই কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই তো এসেছি। খেলে তো সতেরোটা ম্যাচে সাত পয়েন্ট তোর টিম করতে পারত না। গড়ের মাঠে সবাই তোর কেরামতি জানে।”
”তুই এসব কি বলছিস, বিজন! পথ ছাড়।” রতন সরকার ব্যস্ততা দেখাল। ভিড়ের মধ্যে থেকে দু—একটা চাপা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য ওর উদ্দেশে ছোঁড়া হয়েছে। বিজন দত্ত চাপা খুশিতে আরও গলা চড়িয়ে বলে উঠল, ”এক মাঘে শীত পালায় নারে পালায় না। সামনের বছরে আমরা ফাস ডিভিশানে যাবই আর—টেরিলিন প্যান্ট দোব, বেঙ্গল টিমে চান্স করে দোব, বৌকে হাসপাতালে ভর্তি করে দোব, এইসব করে কটা ম্যাচ জিততে পারিস দেখব।”