এবার আমি লোকটির জন্য হতাশা বোধ করলাম। নিজের কল্পনার জগৎকে আরোপ করার চেষ্টা করছে বাস্তব জগতের উপর। ফলাফল ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। মনশ্চক্ষে দেখলাম, কুঁজো হয়ে, পা ফাঁক করে লোকটি টাচ লাইন ধরে ছুটোছুটি করছে আর বিচ্ছু ছেলেরা ওর পিছনে ছুটছে, ভ্যাংচাচ্ছে, হাসছে, জামা ধরে টানছে। মাস্টারমশায়রা বলছেন, পাগলটাকে সরিয়ে দিতে। দেখতে পেলাম, অপমানে লজ্জায় ওর জ্বলজ্বলে চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে। মাঠ থেকে চলে যাচ্ছে মাথা নামিয়ে আর একপাল ছেলে ওর পিছু নিয়েছে।
”এখনই ওকে ম্যাচে নামানোটা কি একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?” যথাসম্ভব নম্রকণ্ঠে বললাম। ”মাত্র ক’দিন তো শেখাচ্ছেন?”
”আমি হিসেব রেখেছি, মোট পঁচিশ ঘণ্টা ওকে কোচ করেছি। ছেলেদের ফুটবলে ভালো স্ট্যান্ডার্ডে রিচ করতে পঁচিশ ঘণ্টার কোচিংই যথেষ্ট।”
”কিন্তু এ ছেলেটাকে তো পাঁচশো ঘণ্টা কোচ করলেও কোনো স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছতে পারবে না।”
প্রথমে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”ইচ্ছেটা যে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার আপনি বুঝবেন না। আপনি ইচ্ছে করুন সামাদ কি ছোনে কি গোষ্ঠ পালের মতো খেলবেন… কিংবা আজকাল যাদের খুব নাম শুনি—পেলে, ইস্যুবিও … তাহলে ঠিক তৈরি হয়ে যাবেন।”
এই নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। ভাবলাম, যা খুশি করুক আমার তা নিয়ে মাথাব্যথার দরকার নেই। বরং শিক্ষা পেলে ওর জ্ঞানচক্ষু ফুটবে। লোকটি এরপর এক সপ্তাহ অনুপস্থিত রইল। রোজই পল্টুর সঙ্গে প্র্যাকটিসের সময় ভাঙা পাঁচিলটার দিকে তাকাতাম। এই বুঝি আসে। পরে মনে হত, ছেলেটা নিশ্চয় ওকে ডুবিয়েছে তাই আমাদের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা পাচ্ছে বলেই আসছে না।
একদিন লোকটিকে আবার দেখলাম। নিমগাছতলায় দাঁড়িয়ে আমাদের প্র্যাকটিস দেখছে। পরনে লুঙ্গি আর হাওয়াই শার্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ওকে দেখতে পেয়েছি বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল, দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ”সেদিনকার ট্রায়াল ম্যাচের খবর কী?”
লোকটি একবার থমকাল তারপর চলতে চলতেই বলল, ”শুধু ইচ্ছেতেই হয় না, কিছুটা প্রতিভাও থাকা দরকার। আমারই ভুল হয়েছে।” এরপর ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে একবার তাকাল। আমি ওর চোখে গাঢ় প্রত্যাবর্তন কামনা দেখতে পেলাম। ওর চলে যাওয়া দেখে মনে হল, একটা আহত জন্তু গভীর অরণ্যের নির্জনে প্রাণ বিসর্জন দেবার জন্য যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে।
কিছুদিন পর বাজার যাবার পথে ছেলেটিকে দেখতে পেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর থেকেও কমবয়েসি ছেলেদের ডাংগুলি খেলা দেখছিল। লোকটির খবর জিজ্ঞাসা করতেই ও বিরক্তস্বরে বলল, ”কে জানে। বোধহয় আবার অসুখ—বিসুখ হয়েছে।”
”কোথায় থাকে জান?”
”জানি, তবে আমি কিন্তু নিয়ে যেতে পারব না। আমায় দেখলেই এমনভাবে তাকায় যেন ভস্ম করে ফেলবে। আচ্ছা, কি দোষ বলুন তো, মাঠে এমন কাণ্ড শুরু করল যে ছেলেরা ওর পেছনে লাগল। এজন্য কি আমি দায়ী?”
”মোটেই না।”
”তাহলে! আমি যদি খারাপ খেলি তাই বলে সকলের সামনে অমন হাউ হাউ করে কাঁদবে একটা বুড়ো লোক?”
”তুমি বরং দূর থেকে বাড়িটা দেখিয়ে দাও। সেটা পারবে তো?” অধৈর্য হয়ে বললাম।
”তা পারব।” ছেলেটি দ্বিধাগ্রস্তস্বরে বলল।
কথামতো দূর থেকে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই ছেলেটি চলে গেল। জায়গাটা আধাবস্তি। তিনদিকে টালির চাল দেওয়া একতলা ঘর, মাঝখানে উঠোনের মতো খোলা জায়গা। অনেকগুলো বাচ্চচা হুটোপাটি চিৎকার করছে। তার পাশেই খোলা নর্দমা, থকথকে পাঁকে ভরা। একধারে লাউয়ের মাচা। চিটচিটে ছেঁড়া তোশক বাঁশে ঝুলছে। আস্তাকুঁড়ে একটা হাঁস ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খাদ্য বার করছে। একজন স্ত্রীলোক এসে একটি বাচ্চচার পিঠে কয়েকটি চড় মেরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার প্রশ্নে, ব্যাজার মুখে একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে চলে গেল। একটু কৌতূহলও প্রকাশ করল না।
ঘরের দরজাটি পিছন দিকে। ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকালাম। দেয়ালে অজস্র ক্যালেন্ডার আর তোরঙ্গ, কৌটো, ঘড়া, বিছানা, মশারি প্রভৃতিতে বিশৃঙ্খল ঘরের কোণায় তক্তপোশে লোকটি দেয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া হয়ে বসে। তাকিয়ে রয়েছে সামনের দেয়ালে। পাশ থেকে দেখতে পেলাম থুতনিটা এমন ভঙ্গিতে তোলা যেন কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না। গালের হাড় উঁচু হয়ে চোখদুটিকে আরও ঢুকিয়ে দিয়েছে। মৃত্যু ওর শরীরে কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে এবং লোকটি আরামে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মনে হল।
হঠাৎ ও ঘাড় ফেরাল। চোখাচোখি হল আমার সঙ্গে। মাত্র কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু ওর চোখে কোনোরূপ ভাবান্তর প্রকাশ পেল না। রিক্ত কৌতূহলবর্জিত শূন্য চাহনি। মনে হল, নিষ্পত্র প্রাচীন এক শিমুলের কাণ্ড, ক্ষয়প্রাপ্ত পাথরের মতো যার বর্ণ, গতিহীন সঞ্চরণে প্রত্যাবর্তনরত। আমি পরিচিতের হাসি হাসলাম। ওর চোখে তা প্রতিফলিত হল না।
ভগ্নস্তূপে সন্ধ্যামণি
জানতাম না বিজন দত্ত এই স্যানাটোরিয়ামে রয়েছে। স্কুল ছুটির পর, ডাক্তার বসুরায়ের কোয়ার্টার্সে মাঝে মাঝে যাই, যদি থাকেন তো গল্প করে সময় কাটাতে। সেদিন উনি বললেন, ”তুমি তো ফুটবল পাগল, বিজন দত্তের নাম শুনেছ?”