পরদিন পল্টু প্র্যাকটিসে এল না। চোট পেয়ে ওর হাঁটু ফুলে উঠেছে। একাই হাজির হলাম মাঠে। নিমগাছতলায় লোকটি বসে। চেলাটি তখনও আসেনি। আমায় দেখে হেসে বলল, ”আর একজন কই?”
কারণটা বললাম। তারপর কথায় কথায় ওর কাছে জানতে চাইলাম, কী করেন, কোথায় থাকেন এবং ফুটবল খেলতেন কোন ক্লাবে। উত্তর দিতে ওর খুব আগ্রহ দেখলাম না। শুধু জানলাম মাইলদুয়েক দূরে ভটচাযপাড়ায় ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন। অবিবাহিত। যুদ্ধে গেছলেন। ফিরে এসে কারখানায় ওয়েল্ডারের কাজ করেন। প্লুরুসি হওয়ায় কাজ ছেড়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে যৎসামান্য জমিজমা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। এখন আর ভালো লাগছে না তাই ছোটভাইয়ের কাছে এসেছেন, কিন্তু এখানেও নানান অসুবিধা—অশান্তি। ভাবছেন, আবার দেশেই ফিরে যাবেন।
”হ্যাঁ, খেলতুম।” কাশতে শুরু করল। পিঠটা বেঁকে গেল কাশির ধমকে। বারকয়েক থুথু ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। ”বরাবর বুট পরেই খেলেছি। একবছর কালীঘাটেও ছিলুম, জোসেফ খেলত তখন। নাম শুনেছেন ওর?”
আমি মাথা নাড়লাম। কী একটা বলতে যাচ্ছিল আবার কাশি শুরু হতেই থেমে গেল। গতকাল বৃষ্টিতে ভেজার মাশুল। এই দুর্বল শরীরে আজ যদি খেলা দেখাতে মাঠে নামে তাহলে নির্ঘাত মারা পড়বে, এই ভেবে ওকে বললাম, ”আজ বোধহয় আপনার শিষ্যটি আসবে না। বরং আপনি বাড়িই ফিরে যান।”
”না, না, আসবে, ঠিক আসবে। বলেছি ওকে ফুটবলার তৈরি করে দেবই, তাতে যদি জীবন যায় তো যাবে। আমি যে পদ্ধতি নিয়েছি তার আর মার নেই। বুঝলেন, যে—কোনো বস্তুর উপরে যদি ইচ্ছার প্রভাব ছড়ানো যায় তাহলে সফল হবেই।” দুবার কেশে নিয়ে আবার বলল, ”বস্তুটি যদি কাঁচা হয়, তার মানে যদি অল্পবয়সি হয় তাহলে যে কাউকেই দুর্দান্ত প্লেয়ার করা যাবে। আমার এখন বয়স হয়ে গেছে, নয়তো নিজের উপরই পদ্ধতিটা পরখ করতাম।”
ছেলেটিকে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে আসতে দেখলাম। লোকটি তখন মাঠের অন্য ধারে প্রায় পত্রহীন একটা শিমুলগাছের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আচ্ছা, গাছ তো তার পাতার মধ্য দিয়ে যা শুষে নেয় তাই দিয়েই খাদ্য তৈরি করে বেঁচে থাকে। তাই যদি হবে তাহলে ওই গাছটা কী করে বেঁচে রয়েছে?” ওর কণ্ঠস্বরে যেন ব্যক্তিগত সমস্যার দায় ধ্বনিত হল—”পাতাই নেই তাহলে বেঁচে আছে কি করে?”
হঠাৎ লোকটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করল এবং দুঃখও বোধ করলাম। যে পদ্ধতিতেই খেলা শেখাক এই গাবদা চেহারার ছেলেটি যে কোনোদিনই ফুটবলার হতে পারবে না, তাতে আমি নিঃসন্দিগ্ধ। ছেলেটাকে একবারও বলে লাথি মারতে না দিয়ে লোকটি নিজেই লাফালাফি করে যাচ্ছে। ছেলেটি সামান্য চনমনে হলে নিশ্চয় এভাবে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না। এরকম হাঁদা ছেলে না পেলে লোকটি তাকে শিষ্যও বানাত না।
প্রায় আধঘণ্টা বসে থেকে লোকটির কর্মকাণ্ড দেখলাম। ছেলেটি চলে যেতেই আমার খাবারটা ওর দিকে এগিয়ে ধরে বললাম, ”আমি তো আজ প্র্যাকটিস করলাম না, তাছাড়া খিদেও নেই।”
ভ্রু কুঁচকে বলল, ”করুন না, আমি গোলে দাঁড়াচ্ছি।”
”না থাক, আজ মন লাগছে না।”
লোকটি আর কথা বাড়াল না। খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে রাখল। কোনো কুণ্ঠা দেখলাম না। বিনয় দেখিয়ে ধন্যবাদও জানাল না। আমরা একসঙ্গেই মাঠ থেকে বেরোলাম, হাঁটতে হাঁটতে লোকটি একসময় বলল, ”আমার কি মনে হয় জানেন, ফুটবলের তুল্য আর কোনো খেলা পৃথিবীতে নেই। ক্রিকেট হকি ব্যাডমিন্টন—টেনিস যাই বলুন, সবই একটা ডাণ্ডা নিয়ে খেলতে হয়। ডাণ্ডা হাতে মানুষ! তার মানে প্রায় সেই বনমানুষের যুগের ব্যাপার। ফুটবল হচ্ছে সভ্যমানুষের খেলা, এর মধ্যে অনেক সায়েন্স আছে। সেটা রপ্ত করতে পারলে… ভালো কথা আপনার কি কোন বাতিল ছেঁড়া বুট আছে? কাল দেখলেন তো কেমন পিছলে পড়ে গেলুম। বুট হলে আরও ভালো ক’রে ডিমনস্ট্রেট করতে পারি।”
মাথা নেড়ে জানালাম, দেবার মতো বুট আমার নেই। শুনে আপসোসে টাগরায় জিভ লাগিয়ে শব্দ করল। ওর গালদুটি লক্ষ্য করলাম, আগের থেকে পাণ্ডুর এবং বসে গেছে। ঢলঢলে নীল পাজামাটার গতদিনের কাদা শুকিয়ে আটকে রয়েছে। তালিমারা বলটা দুহাতে বুকে চেপে ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে ওর হাঁটা প্রায় বাচ্চচা ছেলের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখদুটিতে দারুণ উত্তেজনা। মনের মধ্যে হয়তো প্রতিপক্ষকে একের পর এক ড্রিবল করে এখন কাটিয়ে চলেছে। আমাকে কোনোরকম বিদায় না জানিয়েই মোড়ে পৌঁছে আপনমনে সে নিজের বাড়ির পথ ধরল।
পরের সপ্তাহে ছেলেটিকে প্রথমবার বল নিয়ে নড়াচড়া করতে দেখলাম। দেখে মনে হল ওর থেকে এই আধবুড়ো লোকটি জোরে কিক করতে পারে, ছুটতে পারে, লাফাতে পারে। ছেলেটি কেন যে এত জিনিস থাকতে ফুটবল খেলা শিখতে এল ভেবে অবাক হলাম। আধঘণ্টা পরে, ছেলেটি চলে যাওয়ামাত্র বললাম, ”কীরকম মনে হচ্ছে, হবে—টবে কিছু?”
”নিশ্চয়।” লোকটি প্রচণ্ড উৎসাহে বলল, ”ঠিক করেছি এবার ওকে নামাব। যা কিছু শিখিয়েছি, সেগুলো খেলায় ব্যবহার করার মতো উপযুক্ত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। ওর স্কুলের একটা ট্রায়াল ম্যাচ আছে এই শনিবার, ও খেলবে। আমি টাচ লাইন থেকে দরকারমতো বলে বলে দেব।”
”আগে কখনো কি ওকে খেলতে দেখেছেন?”
”না, তার দরকারই বা কী! এতদিন ধরে যা যা শিখিয়েছি সেটাই আমার দেখা দরকার। উন্নতি করেছে তাতে সন্দেহ নেই, নইলে ট্রায়াল ম্যাচে চান্স পাবে কেন!”