আমি দেখলাম পল্টু মুখ লাল করে ছুটে আসছে। শিউরে উঠলাম। পল্টুর মাথা অল্পেই গরম হয়। সামান্য উসকানিতেই ঘুঁষোঘুঁষি শুরু করে।
”আমরা এখানে এসেছি প্র্যাকটিস করতে,” ভারী গলায় পল্টু বলল। ”আপনাকে তো আমরা ডাকিনি তবে কেন গায়ে পড়ে ঝামেলা করছেন। খেলা যদি শেখাতে চান, তবে অন্য কাউকে ধরে শেখান। প্লিজ আমাদের বিরক্ত করবেন না।”
পল্টু গটগট করে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। লোকটি অবাক হয়ে পল্টুর দিকে তাকিয়েছিল। দেখলাম ক্রমশ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। মাথা নামিয়ে গাছতলার দিকে যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওর ঢলঢলে নীল পাজামা আর কুঁজো পিঠটার দিকে তাকিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া শ্যাওলাধরা একটা পাথরের কথাই মনে এল। আমরা যখন নিমগাছতলায় বসে খাচ্ছিলাম, লোকটি তখন উঠে গেল। খেতে খেতে পল্টু শুরু করল আমাদের নতুন ক্লাবের ফুটবল সেক্রেটারির গল্প। তখন হঠাৎ চোখে পড়ল লোকটি ধীরে ধীরে ছুটতে শুরু করেছে মাঠটাকে পাক দিয়ে। ঠিক আমরা যেভাবে ছুটি। আমার সঙ্গে পল্টুও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
একপাক শেষ করে যখন আমাদের সামনে দিয়ে ছুটে গেল, দেখি জ্বলজ্বলে চোখদুটি কঠিনদৃষ্টিতে সামনে নিবদ্ধ। আমাদের দিকে বারেকের জন্যও তাকাল না। সরু বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। নিশ্বাস নেবার জন্য মুখটা খোলা। পিছন থেকে শীর্ণ ঢ্যাঙা দেহের উপরে রঙের পোঁচের মতো চুলভরতি মাথাটাকে নড়বড় করতে দেখে হাসিই পেল। কিন্তু পরক্ষণেই কষ্ট হল আধবুড়ো লোকটির ওই ধরনের ছেলেমানুষি প্রয়াস দেখে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ও নিজেকে আমাদের সমান প্রতিপন্ন করতে যেন চ্যালেঞ্জ দিয়েই ছুটছে বয়সের বাধা ঠেলে ঠেলে। মনে মনে চাইলাম, ছেলে মানুষের মতো অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ত্যাগ করে এখান থেকে ও চলে যাক।
”টেঁসে না যায়, তাহলে আবার হুজ্জুতে পড়তে হবে।” পল্টুর স্বরে সত্যিকারের উৎকণ্ঠা কিছুটা ফুটল। লোকটা দেড়পাক ছুটেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। মুখ তুলে হাঁ করে আছে। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মনে হল আমাদের দিকে বারকয়েক আড়চোখে তাকালও। হয়তো কোলাপস করে পড়ে যেতে পারে ভেবে আমি উঠে দাঁড়ালাম। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হাঁটার ভঙ্গিতে পাঁচিলের ভাঙা জায়গাটার দিকে এগিয়ে গেল। তাই দেখে আবার কষ্ট পেলাম। পল্টু হো হো করে হেসে উঠল।
দিন ছয়—সাত লোকটি এল না। আশ্বস্ত হয়ে ভাবলাম আর বোধহয় আসবে না। কিন্তু লোকটি এল, সঙ্গে তিন—চারটি তালিমারা ঢ্যাবঢেবে একটি ফুটবল নিয়ে। আমরা যথারীতি প্র্যাকটিস করতে লাগলাম আর তখন সে মাঠের অপরদিকে নিজের বলটি নিয়ে কাল্পনিক প্রতিপক্ষদের নাজেহাল করায় ব্যস্ত রইল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখলাম, বলটিকে পায়ের কাছে রেখে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একবার বলটা ওর দিকে গড়িয়ে যেতেই চোখদুটো চকচক করে উঠল। সামনে ঝুঁকে এগোতে গিয়ে প্রাণপণে নিজেকে যেন ধরে রাখল।
”ক’দিন দেখিনি যে আপনাকে?” বললাম নিছকই সৌজন্যবশত।
”শরীরটা খুব খারাপ হয়েছিল।” গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করল।
ওকে খুশি করার জন্য বললাম, ”দেখুন তো থ্রুগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কিনা।”
একটু পরেই ও চেঁচিয়ে উঠল, ”ওকি ওকি! হচ্ছে না।” আমি ফিরে তাকাতেই আবার বলল, ”চটপট করতে হবে, কিন্তু কম স্পিডে। কিক করার সময়ও তাই। পায়ের পাতার ওপর দিক দিয়ে। বুটের ডগলা মাটির দিকে—এইরকম ভাবে। তারপর ফলো—থ্রুটা হবে—এইরকম! করুন তো একবার।”
ফার্স্ট ডিভিসনে খেলতে যাচ্ছি আর এখন কিনা শুট করার প্রাথমিক নিয়ম এইরকম একটা লোকের কাছ থেকে শিখতে হবে ভাবতেই বিরক্তিতে মন ভরে উঠল। ওকে অগ্রাহ্য করে আগের মতনই শুট করতে লাগলাম। বারদুয়েক চেঁচিয়ে ও চুপ করে গেল। বুঝতে পারছি লোকটির একজন চেলা দরকার, যে ওর উপদেশ শুনবে, মান্য করবে, আমরা যে ওর কথা অনুযায়ী কাজ করব না সেটা নিশ্চয় বুঝে গেছে।
পরদিন সকালে বৃষ্টি পড়ছিল। আমরা মাঠে এসে দেখি চেলা জুটে গেছে। থপথপে বোকা চেহারার একটা ছেলে বৃষ্টির মধ্যে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে, বল নিয়ে লোকটার লম্ফঝম্ফ মনোযোগ করে দেখছে। ওর পাগলামি আর উৎসাহ দেখে অবাক হলাম। কিন্তু বৃষ্টির জল গায়ে বসবার স্বাস্থ্য বা বয়স ওর নয়। পল্টুকে বললাম, ”নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে লোকটার।”
”হোক। কিন্তু এটাকে কোত্থেকে ধরে আনল, একটা হাঁদা গোবর—গণেশ! সারা জীবনেও তো খেলা শিখতে পারবে না।”
দূর থেকেই আমরা শুনতে পেলাম লোকটির নির্দেশ দেওয়া। যেন ক্লাস লেকচার দিচ্ছে। ”বলের উপর দিয়ে যদি এইভাবে যাও”—ছোট্ট একটা লাফ—”তাহলে কিসসু হবে না। তোমায় করতে হবে কি এইভাবে… তারপর এইভাবে নিয়ে যাবে। তাহলে দোনামনায় পড়বে তোমার অপোনেন্ট।”
ছেলেটি একাগ্র হয়ে দেখছে আর প্রত্যেক কথায় ঘাড় নেড়ে যাচ্ছে কিন্তু লোকটি ওকে বল নিয়ে চেষ্টা করতে বলছে না। ”এইবার দেখাচ্ছি কীভাবে পায়ের চেটো দিয়ে পাস দিতে হয়।” বলটা কাদায় আটকে গেল। লোকটি ছুটে গিয়ে ড্রিবল করতে করতে বলটাকে আনল। ছেলেটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির ফোঁটা থুতনি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। চুল কপালে লেপটে। শার্টের ভিতর থেকে গায়ের শাদা চামড়া ফুটে উঠেছে। ”এইবার দেখো ডগা দিয়ে কী করে বল তুলতে হয়।” তুলতে গিয়ে পা পিছলে লোকটি পড়ে গেল। ছেলেটি কিন্তু হাসল না। বরং লোকটিই হেসে উঠল। এই সময় হঠাৎ বৃষ্টির বেগ বাড়তে আমরা প্র্যাকটিস বন্ধ করে ফিরে গেলাম। যাবার সময় দেখি লোকটি ছেলেটির চারপাশে বল নিয়ে ঘুরছে আর নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে।