”আপনারা অ্যাংক্লেট পরলেন না যে?” লোকটির হঠাৎ প্রশ্নে আমরা দুজনেই মুখ ফেরালাম। পল্টু গম্ভীরস্বরে বলল, ”পরার কোনো দরকার নেই, তাই। ওতে সুবিধের থেকে অসুবিধেই বেশি হয়।”
লোকটির চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। আমাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ”কে বলল সুবিধে হয় না, পরে কখনো খেলেছেন?” কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, ”বড় বড় প্লেয়াররা সবাই অ্যাংক্লেট পরেই খেলেছে—সামাদ, ছোনে, জুম্মা, করুণা—কই ওদের তো অসুবিধে হয়নি! ওদের মতো প্লেয়ারও তো আর হল না।”
”আর হবেও না কেননা খেলার ধরনই বদলে গেছে।” এবার আমিই জবাব দিলাম।
”গেলেই বা! শুটিং, হেডিং, ড্রিবলিং, ট্যাকলিং, পাসিং, এসব তো আর বদলায়নি!” লোকটি মিটমিট করে হেসে আবার বলল, ”আজকাল হয়েছে শুধু রকমারি গালভরা নামওলা সব আইডিয়া। সেদিন এক ছোকরা আমায় ফোর—টু—ফোর বোঝাচ্ছিল। আরে এতো দেখি সেই আমাদের আমলের টু—ব্যাকেরই খেলা! হাফ—ব্যাক দুটো নেমে এলেই তো ফোর ব্যাক—”
ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি আর পল্টু নিজেদের মধ্যে চাওয়া—চাওয়ি করে মাঠে নেমে পড়েছি। রোজই প্রথমে আমরা মাঠটাকে চক্কর দিয়ে কয়েক পাক দৌড়ই। শুরু করার আগে পল্টু চাপাস্বরে বলল, ”গুলিখাওয়া বাঘ। অ্যানাদার ফ্রাসট্রেটেড ওল্ড ফুটবলার।”
পাশাপাশি ছুটতে ছুটতে ঘাড় ফিরিয়ে দুজনেই লক্ষ্য করছিলাম লোকটাকে। এক সময় দুজনেই থেমে পড়লাম। বলটা গাছতলাতে রেখে আমরা দৌড়তে নেমেছি। ইতিমধ্যে সেটিকে নিয়ে লোকটা কাল্পনিক প্রতিপক্ষদের কাটাতে ব্যস্ত। প্রায় ছ’ফুট লম্বা লগবগে শরীরটাকে একবার ডাইনে আবার বাঁয়ে হেলাচ্ছে, পায়ের চেটো দিয়ে বলটাকে টানল, বলটাকে লাফিয়ে ডিঙিয়ে গেল, ঘুরে গিয়ে প্রচণ্ড শট করার ভান করে পা তুলে আলতো শটে বলটা ডানদিকে ঠেলে দিয়ে ঝুঁকে যেন সামনে দাঁড়ানো কাউকে এড়িয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে দেখতে লাগল বলটা গোলে ঢুকছে কিনা। বলটা গড়াতে গড়াতে থেমে যেতেই দু’হাত তুলে হাসতে শুরু করল। মনে হল প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের ভ্যাবাচাকা মুখগুলো দেখে হাসি সামলাতে পারেনি।
পল্টুকে বললাম, ”বোধহয় এককালে খেলত।”
নকল আতঙ্ক গলায় ফুটিয়ে পল্টু বলল, ”সেরেছে। মিলিটারিদের সঙ্গে খেলার গপ্পো শুরু করবে না তো!”
”তোর এইসব বাজে ধারণাগুলো মাথা থেকে তাড়া।” ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললাম, ”সে আমলে সত্যিই অনেক ভালো ভালো প্লেয়ার ছিল।”
”হ্যাঁ ছিল। গোরারা তাদের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত। তারা তিরিশ—চল্লিশ গজ দূর থেকে মেরে মেরে গোল দিত। রেকর্ডের খাতা খুলে দ্যাখ সেই সব শটের কোনো পাত্তাই মিলবে না। বড় জোর এক গোল কী দু’গোল, আর বাবুরা খেতেন পাঁচ—ছ গোল।” এই বলে পল্টু আমার জন্য অপেক্ষা না করেই আবার ছুটতে শুরু করল।
আমি মাঠের বাইরে লোকটার দিকে তাকালাম। এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পায়ে বলটাকে মেরে মেরে শূন্যে রাখার চেষ্টা করছে। তিন চার সেকেন্ডের বেশি পারছে না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলটাকে লাথি মেরে মাঠের মাঝখানে পাঠিয়ে দিল। যখন শুটিং প্র্যাকটিস শুরু করলাম লোকটা মাঠে এসে দাঁড়াল। কারখানার মেল্টিং শপের দেয়ালটায় খড়ির দাগ টেনে পোস্ট এঁকে নিয়েছি। ত্রুশবারটা কাল্পনিক। যে সব বল পল্টু ধরতে পারে না, দেয়ালে লেগে মাঠে ফিরে আসে, লোকটা তুমুল উৎসাহে ছোটাছুটি করে সেই বল ধরে, যেন ছাত্রদের সামনে শুটিং—এর টেকনিক বোঝাচ্ছে এমন কায়দায় পা দিয়ে মেরে আমায় ফিরিয়ে দিতে লাগল আর সমানে বকবক করে চলল।
”উঁহুহু, উপর দিয়ে নয়, মাটিতে, সবসময় মাটিতে রাখতে হবে… উপর তোলা মানেই গেল, নষ্ট হয়ে গেল!” ঊর্ধ্বশ্বাসে বল ধরতে ছুটে গেল। ”আজকাল তো সেইসব ক্ল্যাসিক থ্রু পাশ দেখতেই পাই না, কুমারবাবু দিতেন।” আবার ছুটে গেল। ”সেদিন ছোকরাটাকে বলছিলুম, যে ফোর—টু—ফোর বোঝাচ্ছিল… আরে বাবা ছক কষে কি ফুটবল খেলা হয়… মাটিতে মাটিতে, তুলে নয়… হ্যাঁ, এখন অনেক বেশি খেলতে হয় বটে, সে কথা আমি মানি, খাটুনি বেড়েছে… হল না হল না, থ্রু, দেবার সময় পায়ের চেটোটা ঠিক এইভাবে, দিন, বলটা আমায় দিন, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
বলটা ওকে দিলাম। দূর থেকে পল্টু খিঁচিয়ে উঠল, ”আমি কি হাঁ করে ভ্যারেণ্ডা ভাজব? শট কর, শট কর।”
লোকটি অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি বলটা আমার দিকে ঠেলে দিল। ”দমাদম গোলে বল মারলেই কি ফুটবল খেলা হয়, স্কিলও প্র্যাকটিস করতে হয়।” এই বলে লোকটি ক্ষোভ প্রকাশ করল বটে কিন্তু বল ধরে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ বন্ধ করল না। পা ফাঁক করে কুঁজো হয়ে দৌড়ে, বলটাকে ধরেই কাউকে যেন কাটাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে পায়ে খেলিয়ে নিয়ে যেন মহার্ঘ একটি পাস দিচ্ছে, আমার সামনে বলটা বাড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করল, ”শু্যট শু্যট।” গড়ানে বলেই শট করলাম, ঝাঁপিয়ে পড়া পল্টুর বগলের তলা দিয়ে বলটা প্রচণ্ডগতিতে দেয়ালে লেগে মাঠে ফিরে এল। ‘গো—ও—ল…ল” বলে লোকটি হাত তুলে লাফিয়ে উঠল। শটটির নিখুঁতত্ত্বে আমি তখনও চমৎকৃত। লোকটি উত্তেজিতস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ”কাকে থ্রু বলে দেখলেন তো। আর এই জিনিস আপনারা খেলা থেকে কিনা তুলে দিয়েছেন! আজকাল কি যে ম্যান—টু—ম্যান খেলা হয়েছে, বিউটিই যদি না থাকে তাহলে—”