পতু মুখুজ্যে মুচকি হেসে বলল, ”ওরে পরমেশ, গত বছর তো দুজনকে একসঙ্গে আউট দিয়ে আমাদের হারিয়ে দিয়েছিল তোর আম্পায়ার। এবার আমাদের আম্পায়ারও যদি তাই করে?”
”পারবে না করতে। আইনে নেই।”
সবাই চমকে ফিরে তাকাল। স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার বুদ্ধদেবস্যার কখন যেন গুটি গুটি এসে দাঁড়িয়েছেন।
”স্ট্রাইকার এন্ডে স্টামপিং কী রান আউট ডিসিশ্যন দেবে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার অর্থাৎ আমি।”
”কারেক্ট।” সাবজজ বললেন। দারোগাবাবুও মাথা নাড়লেন।
”বেশ, ” পতু মুখুজ্যে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। ”কে আউট তাহলে?”
বুদ্ধদেবস্যার চিন্তিতস্বরে বললেন, ”ইট ইজ এ হিস্টরিক সিচুয়েশন। হঠাৎ একটা ডিসিশ্যন দেওয়া ঠিক হবে না। আইন বইয়ে এরকম কোনো নজিরের কথা আছে কিনা, সেটা আগে দেখতে হবে। না থাকলে লর্ডস—এ রেফার করতে হবে, তাদের মতামত আনাতে হবে।”
”ততক্ষণ কি আমরা এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?” কাঁদোকাঁদো হয়ে পড়লেন পরমেশদা।
”নিশ্চয়।” দারোগাবাবু পঞ্চু কলুর দিকে চোখ রেখে ধমক দিলেন পরমেশদাকে। হাতে বল নিয়ে পঞ্চু ভূতলশায়ী স্টাম্পগুলিকে যক্ষের মতো পাহারা দিচ্ছে। দুজনের কেউ একপা সামনে কী পিছনে নড়লেই সে আবার রান আউটের দাবি জানাতে একটা স্টাম্প মাটি থেকে তুলে নেবে।
”আমি তো গোপী ঘোষ নই যে হুট করে একটা ডিসিশ্যন দিয়ে দেব। তবে আপনাদের মধ্যে কেউ যদি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে রান আউট হতে চান—”
”টিমের মুখ চেয়ে, আপনারই আউট হওয়া উচিত।” সাবজজকে লক্ষ্য করে দারোগাবাবু বললেন, ”আমি এখন সেট হয়ে গেছি, এখন আমার থাকা দরকার।”
”রাবিশ! কুইক রান এখন দরকার যদি জিততে হয়। আমি এসে প্রথম বলই কীভাবে ড্রাইভ করলাম, সেটা নিশ্চয়ই দেখেছেন।”
”আনফরচুনেটলি ব্যাটে বলে হয়ে গেছে। কিন্তু সবগুলো যে হবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।”
ষোলোটি লোক মাঠের মাঝে এবং খেলা বন্ধ রেখে কথা কাটাকাটি করে চলেছে। দর্শকরা প্রথমে উসখুস তারপর চেঁচামেচি শুরু করল। আমি, নন্তু দত্ত এবং আরও কয়েকজন মাঠের মধ্যে এলাম। বুদ্ধদেবস্যারকে ডেকে নিয়ে বললাম, ”গতিক খুব ভালো নয়। যাহোক একটা ডিসিশ্যন দিন।”
”যা হোক! বলো কি, গড—সেন্ট সিচ্যুয়েশন, হাতছাড়া করা যায়?”
”কিন্তু পাবলিক তো তা শুনবে না।” নন্তু দত্ত উদ্বিগ্নচোখে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”ডিসিশ্যন দিয়েছিল বলেই না গোপী ঘোষ ইন্টারন্যাশনাল ফেম পেয়েছে। আপনিও দিন, দেখবেন তারপর দেশেবিদেশে আটঘরার নাম ছড়িয়ে পড়বে।”
বুদ্ধদেবস্যার বিচলিত হলেন। দ্বিধাগ্রস্তকণ্ঠে বললেন, ”কিন্তু কি বলি বলো তো?”
নন্তু দত্ত কিছু না ভেবেই বলল, ”টস করুন। যে হারবে, সে আউট।”
তাই হয়েছিল। আটঘরা শেষপর্যন্ত ২১ রানে হেরে গেলেও কিছু ছেলে অবশ্য খুশি হয়েছিল টসে দারোগাবাবু হেরে যাওয়ায়। শোনা যাচ্ছে পতু মুখুজ্যে চিঠি লিখেছে লর্ডসে। এখনও জবাব আসেনি।
প্রাচীন শিমূল
লোকটা আজও এসেছে। এই নিয়ে পরপর পাঁচদিন।
”কী জন্য আসে বলতো এই ভোরবেলায়?” পল্টুকে বললাম। ”কাল দেখছিলাম আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে আবার হাসছিলও।”
ফুটবলটা মাটিতে ধাপাতে ধাপাতে পল্টু নিমগাছতলাটার দিকে তাকাল। লোকটা ওইখানে বসে রয়েছে। ওইখানেই আমরা পোশাক বদলাই, বুট পরি ও খুলি, প্র্যাকটিসের পর বিশ্রাম নিই, সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খাই। এত ভোরে কারখানার এই মাঠটায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ আসে না। অবশ্য আসার উপায়ও নেই। সারামাঠ পাঁচিলে ঘেরা। শুধু এক জায়গায় পাঁচিলটা ভাঙা। শ্রম ও সময় বাঁচাবার জন্য আমরা সেই ভাঙা জায়গা দিয়েই মাঠে ঢুকি। মাঠ থেকে লোকালয় প্রায় সিকি মাইল দূরে। এ তল্লাটে চার—পাঁচ মাইলের মধ্যে ফুটবল খেলার এতবড় মাঠ আর নেই। আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় এই লোহা কারখানার ফোরম্যান। তার সুপারিশে ম্যানেজারের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছি, সকালে প্র্যাকটিসের। এ বছর থেকে আমরা দুজনেই ফার্স্ট ডিভিশ্যনে খেলব তাই উৎসাহটা বেশিই। গরম পড়তে না পড়তেই প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছি।
”পাগল—টাগল হবে বোধহয়।” পল্টু এর বেশি কিছু বলল না।
গাছতলায় দুজনের ব্যাগ আর বলটা রেখে লোকটাকে গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে আমরা প্রায় নগ্ন হয়েই খাটো প্যান্ট পরলাম। বুট পরতে পরতে একবার তাকালাম খোঁচা—খোঁচা আধপাকা দাড়িওয়ালা, অপরিচ্ছন্ন শীর্ণকায় আধবুড়ো লোকটির দিকে। দুজনেই ঘড়ি খুলে ব্যাগে রেখেছি। আমরা মাঠের মধ্যে থাকব আর এই লোকটা থাকবে ব্যাগদুটোর কাছে, মনে হওয়া মাত্র অস্বস্তি বোধ করলাম। ঘড়ি পরেই থাকব কি না ভাবলাম। পল্টুর পক্ষে অবশ্য সম্ভব নয় কেননা সে গোলকিপার। ওকে প্রায়ই মাটিতে ঝাঁপ দিতে হয়। লোকটাকে যে অন্য কোথাও বসতে বলব, তাতেও বাধো বাধো ঠেকল। ওর সর্বাঙ্গে দারিদ্র্যের তকমা আঁটা থাকলেও, বসার ঋজু ভঙ্গিতে ঝকঝক চাহনিতে বা গ্রীবার উদ্ধত বঙ্কিমতায় এমন একটা সহজ জমকালো ভাব রয়েছে, যেটা ছিঁচকে—চোর সম্পর্কে আমার ধারণার সঙ্গে একদমই মেলাতে পারলাম না।
লোকটি শিশুর কৌতূহল নিয়ে আমাদের বুটপরা দেখছে। এই ক’দিন খয়েরি লুঙ্গি আর সাদা হাওয়াই শার্ট পরে আসছিল, আজ দেখি পরনে ঢলঢলে কিন্তু ঝুলে খাটো, মোটা জিনের নীল পাজামা। বয়লার বা মেসিনঘরের শ্রমিকরা যেরকমটি পরে। চকোলেট রঙের কলার দেওয়া ফ্যাকাসে হলুদ রঙের সিল্কের যে গেঞ্জিটা পরেছে সেটাও ঢলঢলে। মনে হয় অন্য কারুর পাজামা ও গেঞ্জি পরে এসেছে।