”ভুবনডাক্তারকে দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। আমি লক্ষ্য করেছি ভুবনের বলে শিশির দোনামোনায় পড়ছিল—ছয় মারবে না চার মারবে ভেবে পাচ্ছিল না। এই অবস্থায় স্টাম্পিং চান্স সহজেই এসে যায়।”
”তবে কমন ডিসেন্সি থাকলে,” সাব—জজ মুরগির একটা ঠ্যাং তুলে নাকের সামনে নাড়তে নাড়তে বললেন, ”ওরা নিশ্চয়ই এক ঘণ্টার মধ্যেই ডিক্লেয়ার করবে।”
ডিক্লেয়ার করতে হল না। একঘণ্টার মধ্যেই বকদিঘির ইনিংস শেষ হয়ে গেল ২১৪ রানে। কীভাবে যে ঘটল কেউ জানে না। লাঞ্চের পর শিশির প্রথম ওপারেই অলসভাবে (অতি ভোজনের জন্যই বোধহয়) ব্যাট চালিয়ে ইউকেটকিপার বকু বোসকে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যায়। এরপর দুটি ক্ষীণ এল. বি. ডবল্যু. আবেদনে বুদ্ধদেবস্যার আঙুল তুলে দেন।
পাশে—বসা পতু মুখুজ্যের দাঁত কড়মড়ানি শুনে আমার মনে হল বুদ্ধদেবস্যার একটু তাড়াতাড়িই তুরুপের তাস ফেললেন। আটঘরাকে এরপর ব্যাট করতে হবে এবং হরিশ সমতা রক্ষার জন্য আড়াই ঘণ্টা অন্তত সময় পাবে।
আটঘরার পাঁচ উইকেটে ৯২ রান হবার পর নামলেন দারোগাবাবু। সঙ্গে রানার পরমেশদা। ক্যাচটা ফেলার পর তিনি যেটুকু মুষড়ে পড়েছিলেন ইতিমধ্যেই তা কাটিয়ে উঠেছেন।
অপরপ্রান্তে চণ্ডী কম্পাউন্ডার। দারোগাবাবুর ইশারায় সে কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এল।
”রান যখন নেবে, খবরদার পিচের উপর দিয়ে দৌড়বে না। মনে থাকবে?”
চণ্ডী মাথা নাড়ল, দারোগাবাবু এরপর গার্ড নিলেন, মিনিট চারেক ধরে। তারপর সাইট স্ক্রিনের খুঁত বার করলেন। তাঁর মতে বাঁদিকে দু’ গজ অন্তত কম রয়েছে। পতু মুখুজ্জে সায় দিতে তিনি খুশি হয়ে বললেন, ”ক্রিকেট ডেলিকেট গেম। সবাই এটা বোঝে না।”
আটঘরার ইনিংস একশো পার হল প্রধানত দারোগাবাবুর জন্যই। স্টাম্পের সামনে ব্যাট দিয়ে বল থামিয়ে ফেলার অদ্ভুত একটা দক্ষতা ছাড়াও খোঁচা দিয়ে মাঝে মাঝে একটা দুটো রানও তিনি জোগাড় করে ফেলতে পারেন। তার চারটে সিঙ্গল এবং চণ্ডীর একটি ঝাড়ুতে বাউন্ডারি থেকে আটঘরা একশোয় পৌঁছতেই, পরের বলে সে আবার ঝাড়ু চালাল। বলটা ব্যাটের কানায় লেগে স্কোয়্যার লেগের দিকে সোজা আকাশে উঠল।
মিড—অন পড়িমরি ছুটে এসে ক্যাচ ধরার সঙ্গে সঙ্গেই স্কোয়্যার লেগ আম্পায়ার হরিশের উপর সে পড়ল। মাথায়—মাথায় প্রচণ্ড ঠোকাঠুকি চণ্ডী আউট, সেইসঙ্গে হরিশ এবং মিড—অনও। দুজনেরই কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। দুজনকেই মাঠের বাইরে যেতে হল।
মুশকিলে পড়ল পতু মুখুজ্জে। ওই দুজনের জায়গায় নামবার মতো লোক তার নেই। তার স্কোরারকে আম্পায়ার হিসেবে নামাতে পারে কিন্তু মিড—অনের বদলি হবার মতো কেউ নেই। পরমেশদাই উদারকণ্ঠে ওকে বললেন, ”যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের কেউ ফিল্ড করতে পারে তোমাদের হয়ে।”
কী ভেবে পতু মুখুজ্যে রাজি হয়ে গেল। আটঘরার ক্লাস টেনের ছাত্র সুব্রত নামল বকদিঘির হয়ে ফিল্ড করতে। চণ্ডীর জায়গায় ব্যাট করতে এসেছেন সাবজজ।
”স্যার, এখুনি তাড়াহুড়ো করবেন না।” দারোগাবাবু চেঁচিয়ে সাবজজকে বললেন, ‘আগে সেট হয়ে নিন।”
সম্ভবত এই উপদেশ শুনেই সাবজজ প্রথম বলটিতেই ব্যাট হাঁকড়ালেন। একস্ট্রা কভার দিয়ে বল চলেছে। তার পিছনে কাঠবেড়ালির মতো ছুটছে সুব্রত।
ইতিমধ্যে ব্যাটসম্যান দুজন ও রানারের মধ্যে কয়েকটি চিৎকার বিনিময় ঘটল। দারোগাবাবু বললেন: ‘নো’, সাবজজ বললেন : ‘রান’, পরমেশদা বললে : ‘ওয়েট’, সাবজজ : ‘কাম অন’, দারোগাবাবু: ‘ইয়েস’; সাবজজ : ‘নো’, পরমেশদা : ‘হারিআপ’।
দেখা গেল সাবজজ এবং দারোগাবাবুর রানার পরমেশদা দুজনেই ছুটতে শুরু করেছে রান নিতে এবং দুজনেই পিচের মাঝামাঝি পৌঁছে সভয়ে দেখল সুব্রত পরিচ্ছন্নভাবে বলটা কুড়িয়ে নিয়ে ছোঁড়ার জন্য উদ্যত। ওরা ইতস্তত করে থমকে গেল।
”স্যার, ছুটুন।” দারোগাবাবু চিৎকার করল।
”গো ব্যাক।” পরমেশদা বলল।
দেখা গেল দুজনেই একই দিকে ছুটছে। সাবজজ ও পরমেশদা পাশাপাশি পৌঁছলেন নন—স্ট্রাইকার প্রান্তে। দর্শকরা মজা পেয়ে হইহই করে উঠতেই ওরা নিজেদের ভুল বুঝে এবার দুজনেই ছুটল স্ট্রাইকার প্রান্তের দিকে। এবং সেই মুহূর্তে উইকেটকিপার পঞ্চু কলুর গ্লাভসে উড়ে—আসা বলটি জমা পড়তে দেখে দুজনেই পাশাপাশি পিচের মাঝে হাল ছেড়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল।
পঞ্চু কলু রান আউট করার জন্য বেল ফেলতে গিয়েও থমকে গেল। দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কে তাহলে রান আউট হবে? ফ্যালফ্যাল করে সে পতু মুখুজ্যের দিকে তাকাল।
পতু মুখুজ্যে হাত তুলে তাকে প্রথমে বারণ করল। তারপর ভ্রু কুঁচকে পরিস্থিতিটা গোলমেলে বুঝে ইশারায় বেল ফেলে দিতে বলল। পঞ্চু কলু বল হাতে তিনটি স্টাম্পকেই জমিতে শুইয়ে দিয়ে ‘হাউজ দ্যাট’ বলে চিৎকার করল।
বোলিং প্রান্তে হরিশের বদলি আম্পায়ার ছেলেটি আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল : ”আউট।”
পরমেশদার বাহু আঁকড়ে ধরে, গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো সাবজজ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ”কে আউট?”
”আপনি স্যার।” দারোগাবাবু এগিয়ে এলেন পিচের মাঝে।
”রাবিশ! আমি কেন আউট হব?”
”তাহলে আম্পায়ারকে জিজ্ঞাসা করা যাক।”
আম্পায়ার ছেলেটি এইবার ফাঁপরে পড়ল। পরমেশদা আর সাবজজ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কাকে সে আউট দেবে?