দারোগাবাবু আমাকে শুনিয়ে যেতে লাগলেন তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যগুলি। আমি চুপ। এরপর সাব—জজ ব্যাট করতে এলেন।
”সায়ান্স বলে কোনো ব্যাপারই নেই দেখছি। দ্যাখো কাণ্ড, এসেই কিনা হুক করতে গেল। আগে চোখটা সেট করুক, তবে তো রিস্কি শট নেবে।”
”ব্যাটে—বলে হয়েছে তো।” আমি বললাম।
”হয়েছে মানে? এটা তো ক্যাচ! লংলেগের হাতের মধ্যে গিয়ে পড়ল।” দারোগাবাবু পিছন ফিরে কাল্পনিক লংলেগের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেনও। ”পরমেশের উচিত ওকে বলে দেওয়া, কালকের ম্যাচে সেট না হওয়া পর্যন্ত এসব শট যেন একদম বাতিল করে। তবে কী জান, পরমেশের পার্সোনালিটিটা একটু কমই, ক্রিকেট সেন্সটাও। সেদিন দেখলে তো রায়পাড়ার সঙ্গে খেলায়, চণ্ডীকে একবার স্লিপে, একবার ডিপ ফাইন লেগে, একবার লং অনে দাঁড় করাল। প্রত্যেক ফিল্ডারের নির্দিষ্ট জায়গা থাকা উচিত। বারবার এধার ওধার করালে… দ্যাখো দ্যাখো কীভাবে বোল্ড হল! ব্যাট—প্যাডের ফাঁক দিয়ে যে হাতিও গলে যাবে।”
”আরে আরে, মাঠে গোরু ঢুকে…” বলতে বলতে আমি রথতলার দিকে দ্রুত এগিয়ে দারোগাবাবুর কাছ থেকে রেহাই নিলাম।
.
রীতিমতো শোভাযাত্রা করেই বকদিঘি এল। দুটি মোটরে এল পতু মুখুজ্যের সঙ্গে খেলোয়াড়রা এবং আম্পায়ার হরিশ। টেম্পোয় এল খেলার সরঞ্জাম। আর সার বেঁধে শ’খানেক বকদিঘি সমর্থক।
নন্তু দত্ত ওদের অভ্যর্থনা জানাবার ছলে দেখে এল কে কে এসেছে।
”কই শিশিরকে তো দেখলুম না! আম্পায়ারও তো সেই হরিশই এসেছে!”
পরমেশদা বলল, ”পতুর এটাই কায়দা, তুরুপের তাস আগে ফেলে না।”
কথাটা ঠিক। টস হবার দশ মিনিট আগে আর একটা মোটর পৌঁছল এবং তা থেকে নামল শিশির। তৈরি হয়েই এসেছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে ও হাসল। নন্তু দত্ত একবার বলেছিল শিশিরকে চ্যালেঞ্জ করবে। পরমেশদা আপত্তি করে বলে, পতু কাঁচা ছেলে নয়, ঠিক একটা ছবি বার করে দেখিয়ে দেবে।
টস হল। দূর থেকে পতু মুখুজ্যের মুখের হাসি দেখেই বোঝা গেল কে জিতেছে। আর বলার দরকার নেই কারা ব্যাট করবে। ওপেনিং বোলার, ছ’ফুট চার ইঞ্চি চণ্ডী কম্পাউন্ডার যথারীতি সঙ্গে সঙ্গে দশটা ডন আর কুড়িটা বৈঠক দেওয়া শুরু করল। উইকেট—কিপার বকু বোস প্যাড বার করল। দারোগাবাবু হাঁটুতে নী—ক্যাপ পরে নিলেন। বুদ্ধদেবস্যার এবং হরিশ কর্মকার গম্ভীরমুখে ধীর পদক্ষেপে পাশাপাশি রওনা হল উইকেটের দিকে। নামার সময় দুজনেই কঠোরভাবে নিরপেক্ষ—বেলা গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা তা থাকবে কি না, সেটা অবশ্য অন্য কথা।
বকদিঘির ইনিংস একটু চাঞ্চল্যকর ভাবেই শুরু হয়। ব্যাট করতে নামে আলুর আড়তদার বিষ্টু মিশির এবং মুখুজ্যেদেরই একটি ইস্কুলে পড়া ছেলে, অরুণ। চণ্ডীর তিরিশ কদম ছুটে আসা প্রথম বলটিকে অনায়াসেই ‘ওয়াইড’ বলা যায়। থার্ড স্লিপ যথাসময়ে উবু হয়ে বসে না পড়লে ফুলটসটি অবশ্য বাউন্ডারিতে পৌঁছত না। বোলিং প্রান্তে আম্পায়ার বুদ্ধদেবস্যার নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে। হরিশ কর্মকারের ভ্রূ ইঞ্চিখানেক উপরে উঠে কয়েক সেকেন্ডের জন্য কঠিন হয়ে রইল। পরের বলটি নিখুঁত লেংথে, মিডলস্টাম্পের উপর। অরুণের মুখ দেখে মনে হল না, বোল্ড আউট হয়ে সে খুব অখুশি।
খেলতে নামল শিশির। বাকি চারটি বল সে অবহেলায় ছেড়ে দিল, কিন্তু তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখে। চণ্ডীর দ্বিতীয় ওভারেরও সম্মুখীন হল শিশির। পরমেশদার বলে সামিয়ানার ওপর একবার বল ফেলা ছাড়া আগের ওভারে মিশিরজি আর কিছু করেনি। চণ্ডীর প্রথম বলটি পড়ল অফ স্টাম্পের যৎসামান্য, মাত্রই যৎসামান্য বাইরে, সম্ভবত বলটা একটু উঠেছিল, সম্ভবত যতটা জোরে আসবে মনে হয়েছিল ততটা জোরে আসেনি, সম্ভবত শিশিরের মশারির মধ্যে রাতে দু—একটা মশা ঢোকায় ঘুমোতে পারেনি, সম্ভবত সে ঠিক করে উঠতে পারেনি বলটা ছেড়ে দেবে না খেলবে। কারণটা যাই হোক, বলটির দিকে সে প্রায় আনাড়ির মতোই ব্যাট এগিয়ে দেয়। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বলটি আলতো লোপ্পাই হয়ে গালির হাতে অর্থাৎ দারোগাবাবুর হাতে পড়ল বটে কিন্তু অবস্থান করল না। মোটা বেঁটে আঙুলগুলোকে কুঁকড়ে মুঠোয় পরিণত করতে তিনি একটু দেরি করে ফেলেন।
সারা মাঠ স্তব্ধ। দারোগোবাবু গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলেন পায়ের কাছে পড়ে থাকা বলটির দিকে তাকিয়ে। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন, ”হায় মা কালী, বই পড়ার চশমাটা পরে কিনা নেমেছি!”
উনি হাত তুলে ইশারা করলেন। ছুটে এল মাঠের মধ্যে এক কনস্টেবল।
”জলদি আমার ব্যাগ থেকে ডিউটির চশমাটা নিয়ে এসো।”
মিনিটচারেক পর দারোগাবাবুর চশমা বদল হল। ততক্ষণ খেলা বন্ধ ছিল।
খেলার ভাগ্য যে ক্যাচ নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদল হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে ওভার দুয়েক সময় লেগেছিল। দু ওভারের মধ্যেই শিশির ২৪—এ পৌঁছে যায় এবং আটঘরার ফিল্ডাররা বাউন্ডারি থেকে বল কুড়িয়ে এনে প্রতিবারই দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে।
লাঞ্চের সময় শিশিরের ১০৪ এবং বকদিঘির চার উইকেটে ১৭৪।
নন্তু দত্ত কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ”কোনোদিন এমন হয়েছে মনে পড়ে না মতি, লাঞ্চের আগেই দেড়শোর ওপর রান করল আমাদের এগেনস্টে। তাহলে টি—এর আগেই তো সাড়ে তিনশো করে ফেলবে।”
দারোগাবাবু বিরিয়ানির পাহাড়ের মাঝে গর্ত করে তাতে মুরগির ঝোল ঢেলে একটা হ্রদ তৈরি করায় ব্যস্ত ছিলেন। কথাটা তার কানে পৌঁছতেই কাজ অসমাপ্ত রেখে মুখ তুললেন।