”আমি তো সেই কথাই বলছিলাম, বুদ্ধদেবস্যারের মতো আম্পায়ার এই ব্লকে, এই সাবডিভিশ্যনে, এই জেলায় আর দ্বিতীয় কে আছে?” নন্তু দত্ত গর্বে তার আটাশ ইঞ্চি বুক তিরিশ পর্যন্ত ফোলাল।
”গোপীনাথবাবু গতবার যা কেলেঙ্কারিটা ক’রে আমাদের, অর্থাৎ আটঘরার, নাম যেভাবে ডোবালেন, সেই নাম আবার টেনে তুলতে কে আর আছে?” প্রশ্নের সঙ্গেই উত্তরটাও বুঝিয়ে দিতে বুদ্ধুস্যারের দিকে তাকিয়ে আমি গোটা বারো দাঁত ঠোঁট টেনে দেখালাম।
চুপচাপ শুনে যাবার পর উনি শুধু একটি শব্দ করলেন, ‘হুম।”
আমরা মুখ—চাওয়াচায়ি করলাম। পাষাণে ফাটল তাহলে ধরেছে।
”গোপীনাথ ঘোষ আর যাই করুন, ক্রিকেট হিস্ট্রি তো ক্রিয়েট করেছেন।” বুদ্ধুস্যারের এই গম্ভীর ভঙ্গিটা আর শুধুমাত্র দেখা যায় নল—চৌবাচ্চচার অঙ্ক বোঝাবার সময়। ”ওঁর ডিসিশ্যন ক্রিকেট আইন রি—রাইট করিয়েছে, উনি ইন্টারন্যাশনালি ফেমড হয়েছেন এটা ভুলে যাচ্ছ কেন?”
”আপনিও হিস্ট্রি ক্রিয়েট করবেন; আটঘরাকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট জিওগ্রাফিতে স্থাপন করবেন।” আমি বললাম।
”কীভাবে?”
”আপনার প্রাজ্ঞতা, সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত, যুগান্তকারী ডিসিশ্যন দ্বারা।” নন্তু দত্ত তক্তপোশে ঘুঁষি মারল। তলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে একটা বেড়াল বেরিয়ে গেল।
”কীভাবে তা সম্ভব! সেরকম সিচুয়েশন চাই। আমি অঙ্কের লোক তবু বলছি হিস্ট্রি অলওয়েজ ক্রিয়েটেড বাই সিচুয়েশনস।”
”সিচুয়েশন নিশ্চয় তৈরি হবে। ক্রিকেট ইজ এ গেম অব আনসার্টেনিটি। দেখবেন হরিশ হয়তো এমন এক ডিসিশ্যন দিল, তাতেই আপনি সিচুয়েশন পেয়ে যাবেন।”
”হুমম।” পাষাণ বিদীর্ণ হবার শব্দ হল।
.
কোনোবারে যা হয়নি এবার আটঘরায় তাই হয়েছে। নেট প্র্যাকটিস।
মাসছয়েক হল শিবশঙ্কর রাহা দারোগা হয়ে এসেছেন আটঘরায়। বত্রিশ বছর আগে উনি পাটনা ইউনিভারসিটির ক্রিকেট ব্লু হন। তারপর চাকরিতে ঢুকে ক্রিকেট ব্যাট প্রায় হাতেই নেননি। আটঘরায় এসে এখানকার শান্তিপ্রিয় অধিবাসীরা তাকে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ দেওয়ায় তিনি পরিত্যক্ত শখটি আবার ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর উদ্যোগ প্রেরণা এবং চাপে পড়েই নেটের ব্যবস্থা।
শিবশঙ্কর মানুষটি গোঁয়ার, অপরের খুঁত খুঁজে বেড়ান, যা মনে করেন সেটাই সর্বোত্তম ধরে নেন, এবং ক্রিকেট ভালোবাসেন। আটঘরার এলাকার মধ্যে যে—কটি ম্যাচ ইতিমধ্যে খেলা হয়েছে তার সবকটিতেই দলে ছিলেন।
প্রথম ম্যাচেই তিনি জানিয়ে দেন, পয়েন্ট ছাড়া আর কোথাও তিনি ফিল্ড করেন না। পরমেশদা তাকে বহুকষ্টে বোঝাতে পারেন, আজকালকার বোলাররা পয়েন্টে আর লোক রাখে না। গাঁইগুই করে অবশেষে তিনি গালিতে ফিল্ড করতে রাজি হন। মোটামুটি জায়গাটা পয়েন্টেরই কাছাকাছি তো! আমরাও ওকে খুশি করতে সর্বদাই তাই বলে থাকি; ‘ব্যাকওয়ার্ড—পয়েন্টে দারোগাবাবু ফিল্ড করবেন’ বা ‘করছেন’ বা ‘করুন’।
অত্যন্ত জরুরি মুহূর্তে দারোগাবাবুর অভ্যাস ক্যাচ ফেলা। কিন্তু অন্যে ক্যাচ ফেললে তিনি রক্ষা রাখবেন না। ব্যাট হাতে নিয়ে প্রথম দিনই তিনি জানিয়ে দেন, ডাকাত ধরতে গিয়ে পিস্তলের গুলি হাঁটুতে লাগায়, জায়গাটা জখম আছে। রানার ছাড়া তিনি ব্যাট করতে পারবেন না। বিপক্ষ অধিনায়কদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত এমন কাউকে পাওয়া যায়নি, যে আপত্তি করার মতো বুকের পাটা দেখাতে পারে! তবে দারোগাবাবুর ব্যাট করার পালা এলেই দেখা যায় আটঘরার অল্পবয়সি খেলোয়াড়রা গুটিগুটি সটকে পড়ার চেষ্টা করছে। কেউই ওঁর রানার হতে চায় না। অবিরত খ্যাচ খ্যাচ করে যাবেন। কেউই ওঁকে খুশি করতে পারে না।
একবার আমিই ঠিক করে দিই : লটারি হবে। যার নাম উঠবে সে দারোগাবাবুর রানার হবে এবং লটারি বিজয়ীর দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে বাকিরা প্রত্যেকে তাকে দশ পয়সা দেবে। প্রথমবারেই উঠেছিল আমার নাম।
দারোগাবাবুর সঙ্গে মাঠে নেমে স্কোয়্যারলেগ আম্পায়ারের কাছে দাঁড়াই। উনি প্রথম বলটি কভারের দিকে ঠেলে দেওয়া মাত্র আমি ‘ই য়ে য়ে স’ বলেই ছুটে রান নিতে যাই। নন—স্ট্রাইকার বিন্দুমাত্র ব্যগ্র হয়নি ক্রিজ ছাড়তে। আমি অর্থাৎ দারোগাবাবু রান আউট হলেন। মাঠের মাঝে এবং পরবর্তী এক সপ্তাহ উনি আমায় যা যা বলেছিলেন তা উহ্য থাক। তবে আড়ালে ছেলেরা বলেছিল : ”মতিদা আমাদের চিট করেছেন, দু’মিনিটের কাজের জন্য উনি পয়সাটা বেশিই নিয়েছেন।”
পরের দুটি ম্যাচেও রান আউট হয়ে দারোগাবাবু এখন নিজের রানার এক কনস্টেবলকে নিয়ে ব্যাট করতে যান। তবে পরমেশদাকে ছেলেরা জানিয়ে রেখেছে বাৎসরিক ম্যাচে এই বিলাসিতাটি চলবে না। অর্থাৎ টিমেরই কাউকে রানার নিতে হবে।
বাৎসরিক ম্যাচের আগের দিন সকালে কলকাতা থেকে হঠাৎ এসে পড়লেন মলয় সিংহ। সাবজজিয়তি করেন। ক্রিকেটে ভীষণ উৎসাহী। এসেই বললেন, ”কাল খেলব।”
লাঞ্চের অর্ধেক খরচ দেবেন বলা মাত্র, আমি নিজের জায়গাটি ছেড়ে ওঁকে টিমে ঢুকিয়ে নিলাম। দুপুরে নেটে এলেন সাবজজ। গ্রামের অনেকেই দেখতে এল তার এলেমদারি। দারোগাবাবু আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। মলয় সিংহ বল করছেন।
”কোনোরকম সারপ্রাইজ নেই বোলিংয়ে। ভীষণ ইরাটিক। লেংথের যে কী গুরুত্ব, সে সম্পর্কে দেখছি একদম ধারণাই নেই। জোরে জোরে বল করলেই কী আর উইকেট পাওয়া যায়? লেংথ আর ডিরেকশন, এ দুটোই আসল জিনিস। তোমার সাব—জজের তো ব্রেন বলে কিছু নেই। এর থেকে চণ্ডী কম্পাউন্ডার অনেক মাথা খাটিয়ে বল করে।”