ব্যাপারটা উইজডেনের সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছিল। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার কাগজে কাগজে গোপীনাথ ঘোষের নাম ছাপা হয়। পার্লামেন্টেও তিনি অভিনন্দিত হন। কলকাতার কাগজগুলিতে, পতু মুখুজ্যের নামও উল্লেখ করা হয়। ব্যাপারটা নিয়ে সে যদি চিঠি না দিত তাহলে ৪০ আইনে ওই লাইনটার সংযোজনই হত না। মোট কথা, আটঘরা—বকদিঘি বাৎসরিক ম্যাচ রাতারাতি এমনই বিখ্যাত হয়ে গেছে যে শোনা যাচ্ছে, কলকাতা থেকে রিপোর্টার—ফটোগ্রাফারও নাকি এবার বকদিঘিতে আসতে পারে। তাহলে পতু মুখুজ্যের টুপিতে ওটা হবে দ্বিতীয় পালক।
দুই প্রাক্তন জমিদার বাড়ি, আটঘরার সিংহ আর বকদিঘির মুখুজ্যেদের মধ্যে সাবেকি রেষারেষিটা এই বাৎসরিক ম্যাচকে কেন্দ্র করে এখনও জীইয়ে রয়েছে। প্রতিবছর বড়দিনের সময় খেলাটি হয়। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দুই গ্রামের মধ্যে কথাবার্তা এবং যাতায়াত কমে আসে। লাইব্রেরি, টিচার্স রুম, ডাক্তারখানা, কোঅপারেটিভ এবং বি ডি ও অফিস, হেলথ সেন্টার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, শেখ বসিরের কোল্ড স্টোরেজ, নরেন মান্নার দি নিউ নেতাজি ভাণ্ডার অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট—সর্বত্রই থমথমে আবহাওয়ায় ফিসফাস শুরু হয়ে যায়।
এবারেও শুরু হয়েছে।
পতু মুখুজ্যে নাকি বলেই রেখেছে, এবার দেখিয়ে দেবে। কী দেখাবে সেটা নিয়েই জল্পনা—কল্পনা।
শোনা যাচ্ছে, মুখুজ্যেদের বড় তরফের সেজ মেয়ের দ্যাওরপো শিশিরকে ওরা নাকি জামসেদপুর থেকে আনাবে। শিশির গত বছর রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছে বিহারের পক্ষে। কথা উঠেছে, তার খেলার যোগ্যতা নিয়ে। সে বা তার বংশের কেউ বকদিঘিতে কখনো তেরাত্তির বাস করেছে কিনা।
এই ম্যাচে খেলার জন্য যে কটি যোগ্যতা দরকার, তার একটি হল তে—রাত্তির বাস। পতু মুখুজ্যে বলেছে, শিবির তার এগারো বছর বয়সে দুর্গাপূজার সময় এসে সাতদিন বকদিঘিতে ছিল। মেজ খুড়িমার কাছে রক্ষিত, তখনকার তোলা একটি গ্রুপ ফোটো প্রমাণ দেবে।
শোনা যাচ্ছে, পতু মুখুজ্যে কলকাতা থেকে পাশকরা আম্পায়ার আনাবে। বকদিঘির গোবিন্দ বর্ধনের ছোট নাতি জিতু বর্ধন নাকি কলকাতায় আম্পায়ারিংয়ে ভীষণ নাম করে ফেলেছে। এই বছর লিগে প্রথম ম্যাচেই সে দশটি এল.বি.ডব্লু. দিয়েছে। খবরের কাগজে চিঠি লেখালেখি চলছে—ওয়ারল্ড রেকর্ড কিনা?
আজ পর্যন্ত দুই পক্ষের ফল ১৩ : ১৩! একটিও ড্র হয়নি। সুতরাং এবারের সাতাশতম ম্যাচটিকে নিয়ে এগারো মাইল দূরের গোপীনগরে পর্যন্ত বাজি ধরা হবে, সেটা এমন কিছু আশ্চর্যের নয়।
অনেক রকম কথাই কানে আসছে, কিন্তু তাই নিয়ে আমি বা পরমেশ সিংহ বা নন্তু দত্ত একটুও বিচলিত হচ্ছি না। প্রতিবছরই গুজব ওড়ে কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সেই চণ্ডী কম্পাউন্ডার, পঞ্চু কলু, মুকুন্দ মালখণ্ডি, বিষ্টু মিশির, অতুল মুখুজ্যে, ভুবনডাক্তার, আর কুড়িয়ে—বাড়িয়ে ইস্কুলের ছেলেদের নিয়েই টিম হয়। আম্পায়ার থাকে বকদিঘি ড্রামাটিক সোসাসটির প্রম্পটার হরিশ কর্মকার আর আটঘরা উচ্চ—মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অঙ্কের বুদ্ধদেবস্যার।
একটা গোলমাল অবশ্য দুবছর আগে বুদ্ধুস্যারকে (কিছু ছেলে আড়ালে বলে) নিয়ে হয়েছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার করার টোপ দেখিয়ে বকদিঘি ইস্কুলের সেক্রেটারি নাকি ওঁকে দিয়ে ম্যাচ জিতে নেয়—তিনটি রান আউট, দুটি এল বি ডব্লুর সাহায্যে। আমরা অবশ্য এসব কথা একদমই বিশ্বাস করি না। বুদ্ধদেবের মতোই বুদ্ধুস্যার নির্লোভ এবং অহিংস। অপবাদের প্রতিবাদে গত বছর তিনি আম্পায়ার হননি, তাই গোপীনাথ ঘোষকে আমরা নামিয়েছিলাম।
এই বছর দু—মাস আগে আমরা তিনজন ওঁর বাড়িতে যাই। না গিয়ে উপায় নেই। ক্রিকেট—আইন—জানা আটঘরায় কেউ আর নেই। বাইরের কাউকেও নামাতে ভরসা হয় না, কেননা, বুদ্ধুস্যারের মতো আটঘরা—প্রেমিক তিনি হবেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। হরিশ যতটা বকদিঘির জন্য গাত্রচর্ম পুরু করে ফেলে, তার সঙ্গে তাল দিয়ে বুদ্ধুস্যারও চক্ষুলজ্জা খসিয়ে দেন। রান আউটের বদলে রান আউট, এল.বি.ডব্লুর. বদলা নিতে এল.বি.ডব্লু.—এই হচ্ছে তার নীতি। কিন্তু দুবছর আগের ম্যাচটিতে হরিশের দেওয়া দুটি স্টাম্প আউটের (স্ট্রাইকারের পা ব্যাটিং ক্রিজের একবিঘত ভিতরে) বদলা নিতে না পারায়, তার নামে অপবাদ রটে।
বুদ্ধুস্যার তো আমাদের দূর থেকে দেখেই মাথা নাড়তে শুরু করেছেন।
”নো, নো, নো, আই ওন্ট স্ট্যান্ড অ্যাজ আম্পায়ার। নেএএভার।”
আমরা তিনজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম মিনিট দুই।
গলা খাঁকারি দিয়ে অবশেষে পরমেশদা ধরা গলায় বলল, ”এবার আমরা, মানে আটঘরা, হেরে যাব।”
বিষণ্ণকণ্ঠে নন্তু দত্ত বলল, ”তারকেশ্বর থেকে ব্যান্ড পার্টি আনবে বলেছে পতু মুখুজ্যে। এই রাস্তা দিয়েই হয়তো বাজাতে বাজাতে, নাচতে নাচতে যাবে।”
আমি যথাসাধ্য ক্ষুব্ধস্বরে বললাম, ”হরিশ একটা অশিক্ষিত মূর্খ, যে ইংরিজি জানে না, ক্রিকেট রুলস পড়েনি, সে কিনা এই রকম এক নোবল গেমে আম্পায়ার হয়ে আমাদের, অর্থাৎ আটঘরাকে, বেইজ্জত করে ছাড়বে। তাই দেখতে হবে আমাদের, অর্থাৎ আটঘরার লোকেদের?”
”আপনি কী বলেন? মনে হয় না কি, একজন আইনজ্ঞ, কড়া, নির্ভীক, সৎ আম্পায়ার, আপনার মতোই কেউ, আর এক এন্ডে থাকা দরকার?” পরমেশদা কাঁচুমাচু দেখাবার জন্য চশমাটা খুলে ফেলল।