”যে সব গোল মিস করছিল…”
হঠাৎ চন্দনের ইচ্ছে হল এই লোকটিকে কষ্ট দিতে। এই নাকসিঁটকানো ভাবটা সে অনেক দেখেছে। ঈর্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।
”জানেন কি এখন ফুটবলাররা কেমন টাকা পায়?”
”না, কাগজ পড়তে পারি না, লেখাপড়া তো করিনি।”
”চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট হাজারও।”
”আমি একবার একশো টাকা পেয়েছি মোহনবাগানকে গোল দিয়ে। বকাইবাবু দিয়েছিল খুশি হয়ে। কমল ওই রকম বল না দিলে গোলটা পেতাম না। ওকে পঞ্চাশ দিয়েছিলাম।”
”এখনকার অনেক প্লেয়ারেরই গাড়ি আছে, অনেকেই বাড়ি করেছে, দোকান ব্যবসা ফেঁদেছে, হাজার হাজার টাকা জমিয়েছে।”
কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। পঁয়ত্রিশ—চল্লিশ বছর আগের কোনো একটা দিনে ফিরে গিয়ে ও বোধহয় সেই গোলটা দেখতে পাচ্ছে। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
”আমার হেডিং নাকি খারাপ অথচ গোলটা পেয়েছিলাম হেড করে। বাজে কথা রটানো হয়েছিল আমার সম্পর্কে। জীবনে অনেক গোলই আমি হেড করে দিয়েছি।”
তক্তপোশ থেকে নেমে রবারের বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চন্দনকে দিল। হাত ধরে ওকে ঘরের বাইরে আনল।
”এটা ছুঁড়ুন। আপনাকে দেখাচ্ছি কীভাবে গোলটা করেছি, ছুঁড়ুন।”
চন্দন বিব্রত হয়ে, কিছুটা মজাও পেয়ে বলটা আলতো করে ওর মাথার উপর তুলে দিল। হাত মুঠো করে, অল্প কুঁজো হয়ে ও তৈরি।
বলটা ওর কাঁধের উপর পড়ল। ফসকে গেছে। চন্দন কুড়িয়ে নিয়ে এবার আরও আলতো, আরও উঁচু করে তুলে দিল।
মুখ তুলে অপেক্ষা করছে শিবকৃষ্ণণ। বলটা যখন মাথার কাছাকাছি তখন বাঁ ধারে হেড করার জন্য মাথা ঝাঁকাল। ওর থুতনির উপর পড়ল।
অপ্রতিভ হয়ে শিবকৃষ্ণণ বলটার দিকে তাকিয়ে রইল মুখ নিচু করে।
”আবার দিন।”
চন্দন আরও তিনবার বল শূন্যে ছুঁড়ল। তিনবারই ও ফসকাল।
”থাক।”
”না না, আমি পারব, আপনি আবার ছুঁড়ুন।”
দূর থেকে পর পর দু’বার মোটরের হর্ন ভেসে এল। ত্রিপিত নিশ্চয়।
”থাক, আপনার শরীর খারাপ।”
”আর একবার, শুধু একবার।”
বৃদ্ধ যেন ভিক্ষা চাইছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল চন্দনের।
”এই শেষবার।”
শিবকৃষ্ণণ অপেক্ষা করছে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, ঘাড় এবং বাহুর শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদ। পিছনে শাখাপ্রশাখা—মেলা বিরাট এক বটগাছ। তার পিছনে বিস্তৃত ক্ষেত। কচি ধানের চারা। লাঙ্গল দিচ্ছে চাষী। ডানদিকে একটা ডোবা। কলাগাছ। দূর থেকে ভেসে এল ইলেকট্রিক ট্রেনের হুইসল। এইসবের মধ্যে এককালের ফুটবলার, প্রায় অসমর্থ, পঁয়ত্রিশ—চল্লিশ বছর আগের যৌবনে ফিরে যাবার জন্য জেদ ধরে দাঁড়িয়ে। জীবনে শেষবারের মতো ও একটা হেডিং দেখাতে চায়।
যদি এবারও ফসকায়? দূরে অধৈর্যভাবে হর্ন বাজল।
এবারও যদি ফসকায়, তাহলে বৃদ্ধ চুরমার হয়ে যাবে। বরং থাক। ওর হেড করা দেখে কোনো লাভ নেই। চন্দন বলটা মাটিতে ফেলে দিল।
”কী হল?”
”না। আমার সময় নেই, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে?”
”শুধু একবার, এই শেষ।”
চন্দন হাঁটতে শুরু করেছে। ওর পিছনে পিছনে আসছে শিবকৃষ্ণণ।
”কতটুকু সময় আর লাগবে, একবার… হেড করতে পারি কি না পারি দেখাব। কলকাতায় গিয়ে আপনি বলবেন, শিবের হেডিং দেখেছি ষাট বছরের শিবের… একটুখানি, একমিনিটও লাগবে না…”
চন্দন হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধ ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বোম্বাই রোডে পা দিয়ে চন্দন একবার পিছনে তাকায়। বিরাট মাঠ, বিরাট বটগাছের পটভূমিতে জীবনের কিনারায় পৌঁছানো ক্ষীণ চেহারার একটা মানুষকে সে দেখতে পেল।
চন্দন তখনি ঠিক করল, জ্যোতিষীর কথামতো কালই মুক্তোর আংটি গড়াতে দেবে।
আবার এম্পিয়ারিং
পার্লামেন্ট মেম্বর গোপীনাথ ঘোষ (নামের শেষে এম পি অক্ষরদুটি দেখতে না পেলে অম্বলে আক্রান্ত হন) তাঁর আম্পায়ারিং দ্বারা আটঘরা—বকদিঘি ক্রিকেট ম্যাচটিকে গত বছর ঐতিহাসিক মর্যাদায় ভূষিত করে গেছেন। একটিবার তর্জনী তুলেই তিনি একসঙ্গে দুজনকে আউট ঘোষণা করেছিলেন। পীচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভুবনডাক্তার ক্যাচ লোফার জন্য তৈরি সেই সময় দুইদিক থেকে, ব্যাট হাতে অতুল মুখুজ্যে ও বিষ্টু মিশির বুলডোজারের মতো তার ঘাড়ে এসে পড়ে। ক্যাচটা আর লুফতে পারেননি ডাক্তারবাবু। গোপীনাথ ঘোষ একই সঙ্গে মুখুজ্যে ও মিশিরকে ক্রিকেটের ৪০ আইন, ‘অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড’ অনুসারে আউট দিয়ে দেন। ম্যাচটা হেরে যায় বকদিঘি। অল্পস্বল্প ফিসফাস ছাড়া, সেদিন কেউ এম.পি—র সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেনি।
তবে বকদিঘির পতু মুখুজ্যে পরদিনই হুগলি ডি এস এ—কে ঘটনাটি জানিয়ে, অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড আইনে দুজন ব্যাটসম্যানকে একই সঙ্গে আউট দেওয়া আইনসম্মত কিনা এই প্রশ্ন তুলে চিঠি দেয়। ডি এস এ চিঠিটা পাঠায় সি এ বি—কে, নির্দেশ প্রার্থনা করে। সি এ বি চিঠিটা রেফার করে ক্রি—কন্ট্রোল বোর্ডের রুলস সাব—কমিটির কাছে। তারা দুটি জরুরি মিটিং ডেকে সমস্যার ফয়সলা করতে না পেরে অবশেষে লর্ডসে এম সি সি—র দ্বারস্থ হয়। গোপীনাথের ডিসিশ্যন কী পরিস্থিতিতে কীভাবে দেওয়া হয়েছে, মাঠের ছবি, যাদের আউট দেওয়া হয় তাদের সঠিক পজিশনের ছবি ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চেয়ে চারটি চিঠি আসে লন্ডন থেকে বোম্বাই, কলকাতা ঘুরে বকদিঘিতে। অবশেষে ইম্পিরিয়াল (তখন ওই নাম ছিল) ক্রিকেট কনফারেন্সে প্রসঙ্গটা ওঠে। আট ঘণ্টা তর্কাতর্কির পর অবশেষে ৪০ আইনের সঙ্গে একটি লাইন জুড়ে দেওয়া হয় : ইট ইজ দ্য স্ট্রাইকার হু ইজ আউট।