”হ্যাঁ।”
ভাঁড়টা এগিয়ে ধরে বলল। চন্দন সেটা নিতে নিতে বলল : ”আপনি?”
”বৌ।”
”উনিই তো যুগের যাত্রীর শিবকৃষ্ণণ?”
”কী জানি!”
চন্দনের বিস্মিত প্রতিধ্বনিতে ভ্রু কুঁচকে স্ত্রীলোকটি তাকাল।
”উনি তো ফুটবল খেলতেন?”
”হবে। আমি ওসব কিছু জানি না।”
”উনি কোথায়?”
”ঘরে।”
”কিছু করছেন কি, মানে ব্যস্ত? দেখা হতে পারে?”
”করবে আবার কী, যা করার সেতো আমিই করি। দিনরাত তো বিছানাতেই পড়ে থাকে।”
”কিছু হয়েছে কি ওনার?”
”মাথায় যন্ত্রণা, হাঁটুতে ব্যথা, বুকে হাঁপানি, সর্দি কাশি—আপনি কি ওর চেনা? হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন?”
”চেষ্টা করতে পারি।”
শিবকৃষ্ণণের বৌ চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেকে বলল : ”আমি এখন দোকান ছেড়ে যেতে পারব না, তুই সঙ্গে করে নিয়ে যা।”
ছেলেটির সঙ্গে চন্দন কয়েক পা এগোতেই ডাক পড়ল : ”চায়ের পয়সাটা দিয়ে যান।”
দাম চুকিয়ে সে রওনা হল। গাড়িটা খারাপ হওয়া এখন তার কাছে ‘শাপে বর’ মনে হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে সবাইকে চমকে দেবে।
শিবকৃষ্ণণকে সে খুঁজে বার করেছে, কথা বলেছে। সবাই তো ধরেই নিয়েছে, ও মারা গেছে।
জ্যান্ত শিবকৃষ্ণণকে দেখে আসার গল্প করলে সবার আগে দৌড়ে আসবে তো খবরের কাগজের, ম্যাগাজিনগুলোর লোকেরা।
অল্প দূরেই ছোট্ট একটা কুঁড়ে। একখানিই ঘর। দরজায় দাঁড়িয়ে চন্দন ভিতরে তাকাল। দেয়ালে এক হাত গর্ত, এটাই ঘরের জানালা। ওর মনে হল নিচু তক্তপোশে একটা লোক শুয়ে। ঘরে আসবাব কিছুই নেই। গোটাদুই অ্যালুমিনিয়াম থালা আর একটা মগ মেঝেয় উপুড় করা। একটা মাটির হাঁড়ি, জলের কলশি আর কয়েকটা শিশি। তক্তপোশের নিচে টিনের সুটকেশ, একজোড়া পুরনো চটি। দেয়ালে দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। কুলুঙ্গিতে কয়েকটা কৌটো আর বিঘতখানেকের আয়না।
লোকটি অর্থাৎ শিবকৃষ্ণণ, যে কলকাতা বা ভারতের ফুটবল মাঠে সাতাশ বছর আগে ‘শিব’ নামে খ্যাত ছিল—পাশ ফিরে শুয়ে। পরনে জীর্ণ লুঙ্গিমাত্র।
ছেলেটি পিঠে ধাক্কা দিতেই চিত হয়ে মুখ ফেরাল।
”আমি কলকাতা থেকে এসেছি। গাড়িটা খারাপ হয়ে বন্ধ হতে চা খাবার জন্য দোকানে বসি। ছবিটা দেখে ভাবলুম দেখেই যাই মানুষটাকে, এত গল্প শুনেছি আপনার সম্পর্কে।”
শিব উঠে বসল। ছবির লোকটির সঙ্গে চেহারার কোনো মিল নেই। কাঁচা পাকা দাড়ি—গোঁফে গালের গর্ত ঢাকা, হাতদুটো লাঠির মতো সরু, বুকের প্রায় সব পাঁজরই গোনা যায়। শুধু মাথাটার আকৃতি থেকে অনুমান করা যায় এই লোকই শিবকৃষ্ণণ। দেহের সঙ্গে বেমানান আকারের বেঢপ মাথাটা, কপাল মাত্রাতিরিক্ত চওড়া। অথচ হেডিং নাকি খুবই বাজে ছিল।
”আমার বিষয়ে গল্পই শুনেছেন, নিশ্চয় খেলা দেখেননি। বয়স কত?”
দুর্বল কণ্ঠস্বর। প্রায় চল্লিশ বছর বাংলায় বাস করে নিখুঁত বাংলা উচ্চচারণ।
”না, দেখিনি, ঐ ছবিটা যখনকার তখনও আমি জন্মাইনি। আপনার কী অসুখ? সিরিয়াস কিছু কি?”
”না না, অসুখটসুখ কিছু নেই। এরকম শরীর খারাপ ফুটবলারদের তো হয়ই। বল নিয়ে আধঘণ্টা মাঠে এধার ওধার করলেই ঠিক হয়ে যায়।”
”আপনি কি এখনও মাঠে নামেন নাকি?”
চন্দন অবাক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। এই শরীর, এই বয়স—বলে কী!
”মাঠে নামব যে, মাঠ কোথায়, বল কোথায়?” একটু হেসে বলল, ”বয়স কোথায়, হেলথ কোথায়? আসলে আমার মনে হয়, ফুটবলারের শরীরের অসুখ সারতে পারে শুধু খেলে, বল খেলে। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন বসুন।”
তক্তার তলা থেকে ছেলেটা একটা রবারের বল বার করে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। দূর থেকে ওর মায়ের চিৎকার শুনেই বলটা ফেলে রেখে ছুটে বেরিয়ে গেল।
”বৌ আমার বাঙালি, এখানকারই মেয়ে। কলকাতায় হোটেলে কাজ করত, আমিও করতুম, তখন পরিচয় হয়। আমার জন্য অনেক করেছে, এখনও করে।”
”আপনার এই অবস্থা—ফুটবলারদের সাহায্য—টাহায্য, পেনসন এসব এখন তো দেওয়া হচ্ছে, অ্যাপ্লাই করুন না।”
যেভাবে তাকিয়ে আছে চন্দনের মনে হল না তাতে অভিমান রয়েছে। অথচ বুড়োরাই তো বেশি অভিমানী হয়।
”টাকার তো সব সময়ই দরকার।”
”আমি তাহলে ফুটবল খেললাম কেন, অন্য কিছু করে টাকা রোজগার করতে পারতাম তো। খেলে তো টাকা পেতাম না।”
চন্দন অস্বস্তি বোধ করল। সত্যিইতো, এরা তাহলে কীসের জন্য খেলত? হাততালির জন্য! এইটুকু ছাড়া আর কী?
”আপনি কোনো খেলাটেলা করেন?”
চন্দন বলতে যাচ্ছিল, আপনার ক্লাবেই এখনও আমি ‘স্টার’ গণ্য হই। কিন্তু বলতে গিয়ে, গলাটা কে যেন চেপে ধরল। কোনোক্রমে বলল :
”একটু আধটু, ফুটবলই।”
”অ।”
শরীরে রোগ নেই, আর্থিক কষ্ট নেই, ভালোই আছি,—চন্দনের মনে হল এই বুড়োটা একটু যেন হামবড়া ধরনের।
”আপনি খেলাটেলা দেখেন?”
”বছরপাঁচেক আগে খড়্গপুরে একটা ম্যাচ দেখেছি, তাও ষোলো বছর বাদে।”
পাঁচবছর আগে চন্দন খড়্গপুরে একটা একজিবিসন ম্যাচ খেলে গেছে। দেড়শো টাকা নিয়েছিল। সেই ম্যাচটাই কি?
”কী মনে হল এখনকার প্লেয়ারদের।”
বৃদ্ধ চুপ করে রইল।
”আপনাদের সময়ে আর এখনকার সময়ের খেলায় অনেক বদল হয়ে গেছে।”
”কিন্তু স্কিল, সেন্স, সুটিং এসব?”
এবার চন্দন চুপ করে রইল।
”আমার খালি রসিদের, সোমানার, মেওয়ার, আপ্পার কথা মনে পড়ছিল।”
এবার চন্দন আড়চোখে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু—ঘণ্টা কেটেছে, ত্রিপিতের ফেরার সময় হল। দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুজি করবে। কাল ম্যাচ আছে পোরটের সঙ্গে। ইজি ব্যাপার, তাহলেও তাড়াতাড়ি ফিরে রেস্ট নিতে হবে। তিনটে দিন খুবই ধকলে কেটেছে।